Thursday, February 14, 2013

নবজাগরণ মঞ্চ ৯ দিন নীরবতার শক্তি দেখাল বাংলাদেশ |


মঙ্গলবার বিকেল চারটা। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। কয়েক সেকেন্ড আগেও যে স্থান ছিল মিছিল-স্লোগানে প্রকম্পিত, হুট করেই সেখানে নেমে এল রাজ্যের নিস্তব্ধতা। উপস্থিত লাখো মানুষের কারও মুখে কোনো কথা নেই। তবে প্রত্যেকের হাতগুলো ওপরে তোলা।
শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মতো একই দৃশ্য ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়। শাহবাগের তরুণদের ডাকে সারা দেশের মানুষ গতকাল চারটা থেকে চারটা তিন মিনিট পর্যন্ত যে যাঁর অবস্থানে থেকে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। এ সময় স্তব্ধ হয়ে যায় রাজপথ। থেমে যায় সব গাড়ির চাকা। 
গোটা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ গতকাল রাস্তায়, বাড়িতে, খেলার মাঠে বা কর্মস্থলে দাঁড়িয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে অভিনব এই কর্মসূচি পালন করেছেন। দেশের মানুষ গতকাল ১৮০ সেকেন্ডের নিস্তব্ধতার একটি গান শুনিয়েছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন নীরবতা কত শক্তিশালী, তাঁরা দেখিয়েছেন মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে তাঁরা কতটা একাত্ম। 
গত সোমবার শাহবাগের নবজাগরণ মঞ্চ থেকে নীরবতার এ কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছিল। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সব বয়সের, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে এই নীরবতা কর্মসূচি পালন করেন।
অনন্য শাহবাগ: চারটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। লাকী আক্তারের কণ্ঠের স্লোগান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শাহবাগে উপস্থিত লাখো মানুষের কণ্ঠে। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে যেদিকে চোখ যায়—কেবল মানুষ আর মানুষ। তিনটা ৫৯ মিনিটে মূল মঞ্চ থেকে বলা হলো আর এক মিনিট বাকি। আমরা এখন মুহূর্ত গণনা করব। এরপর শুরু হলো ৬০, ৫৯, ৫৮...। যেই শূন্যে এল অমনি নেমে এল স্তব্ধতা।
রাজধানীর সড়কে যেখানে যেভাবে ছিল, সেখানে থেমে গেল সব গাড়ি; সব মানুষ দাঁড়িয়ে পড়লেন রাস্তায়। তিন মিনিট পর কর্মসূচি শেষ হলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আবারও নীরবতা ভাঙেন সেই লাকী।
শাহবাগের এই কর্মসূচিতে লাখো মানুষের সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ।
স্তব্ধ রাজধানী: তরুণ প্রজন্মের ডাকে সাড়া দিয়ে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দাঁড়িয়ে তিন মিনিটের নীরবতা পালন করেন সাংসদেরা। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের নায়ক তোফায়েল আহমেদ, শিরীন শারমিন চৌধুরী, সেগুফতা ইয়াসমিন, মঈন উদ্দীন খান বাদল, মুজিবুল হক, খান টিপু সুলতানসহ শতাধিক সাংসদ এবং সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।
সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে একইভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেন মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শফিক আহমেদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, শাজাহান খান, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, শামসুল হক টুকু, ইয়াফেস ওসমান, দীপঙ্কর তালুকদার প্রমুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির আন্দোলনে একাত্মতা জানান।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। পল্টনে কর্মসূচি পালন করে সিপিবি, বাসদসহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ঢাকার সব জায়গাতেই গতকাল এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। চারটা বাজার আগেই কারওয়ান বাজারে অবস্থিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক-কর্মী, সরকারি ও বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী, দোকানদারসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেন। প্রথম আলো, রেডিও এবিসি, ডেইলি স্টার, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, এনটিভি, আরটিভি, একুশে টিভি, বণিক বার্তা, ইত্তেফাক, মানবজমিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও কর্মীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক, বিমা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অংশ নেন। চারটার সময় রাস্তার দুই পাশ থেকে আসা যানবাহনগুলোও দাঁড়িয়ে যায়। সেখান থেকে যাত্রীরাও গাড়ি থেকে নেমে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েন। চারটা থেকে চারটা তিন মিনিট পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক এলাকা।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একইভাবে নীরবতা পালন করেছে সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ। এতে আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার, আনিসুল হক, আবদুল মতিন খসরু, সুব্রত চৌধুরী, এ কে এম সাইফুদ্দিন আহমেদ, তানিয়া আমীর প্রমুখ অংশ নেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়ে স্তব্ধতা কর্মসূচি পালিত হয়েছে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামেও। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খুলনা রয়েল বেঙ্গলস ও সিলেট রয়্যালসের মধ্যকার মঙ্গলবারের প্রথম খেলা চলার সময় নীরবতা পালন করা হয়। বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানসহ ক্রিকেটার, আম্পায়ার, বিসিবির কর্মকর্তা, দর্শক ও সাংবাদিকেরাও এতে যোগ দেন। 
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যাংকিং খাতের লোকজনও। গতকাল চারটায় সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এসে দাঁড়ান গভর্নর আতিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েক হাজার কর্মকর্তা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। 
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, দুই কমিশনার মো. বদিউজ্জামান ও মো. সাহাবুদ্দিন, দুদকের সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরীসহ দুদকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বিকেল চারটায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ের নিচে দাঁড়িয়ে নীরবে প্রজন্ম আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। 
রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ব্যস্ততা আর উচ্চ শব্দ যখন নিত্য সময়ের সঙ্গী, সেখানে মঙ্গলবার চারটা থেকে চারটা তিন মিনিট একেবারে নীরব হয়ে পড়ে পুরো এলাকা।
শিবিরের হামলায় আতঙ্কিত নয় মানুষ: শাহবাগে তারুণ্যের প্রতিবাদের অষ্টম দিন ছিল গতকাল। টানা আট দিন রাজপথে কাটালেও এতটুকু ক্লান্তির ছাপ নেই আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে। স্লোগান, কবিতা, গান আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জনতার কণ্ঠে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি চলছেই। মঙ্গলবার সকাল থেকেই নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে গিয়ে আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। 
এদিকে রাজধানীর মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, রাসেল স্কয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে গতকাল দুপুরের পরপরই তাণ্ডব চালায় শিবির। শাহবাগে জনতার স্রোত তাতে সামান্যও কমেনি। বেলা তিনটা থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে শাহবাগে। সবকিছু উপেক্ষা করে বিকেল চারটার আগেই শাহবাগে জড়ো হয়ে যান লাখো মানুষ। 
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বেলা সোয়া ১১টার কিছু পর গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি এ সময় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা যে পথ দেখাল, তা আমি মাথা পেতে নিলাম।’ পরে আবুল বারকাতের লেখা বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি বইটির ১০ হাজার কপি বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়।
কাল মোমবাতি প্রজ্বালন: কাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে সারা দেশে একযোগে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তিন মিনিট নীরবতা কর্মসূচি পালনের পর গতকাল মঙ্গলবার নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ব্লগার ও ফেসবুক অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার। 
আয়োজকদের একজন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যে যেখানে থাকবেন, সেখানেই একটি করে মোমবাতি জ্বালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানোর কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারবেন।

No comments:

Post a Comment