Tuesday, March 5, 2013

সহিংসতা বন্ধ করতে উদ্যোগী মানুষ

সহিংসতা প্রতিরোধে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সভা-সমাবেশ, কমিটি গঠন, এলাকা পাহারার ব্যবস্থা করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ। তবে এসব উদ্যোগের বিষয়ে জানে না জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ।
মানুষের জানমাল ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির রক্ষার্থে গতকাল সোমবার রাত থেকে পাহারা দেওয়া শুরু করেছেন শিবগঞ্জ পৌর এলাকার যুবকেরা। সভা করে নিজ এলাকায় সহিংসতা না করার এবং অন্য এলাকার সহিংসতায় না জড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন শাহবাজপুর ইউনিয়নের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা। শান্তি প্রতিষ্ঠার এসব উদ্যোগের পর শিবগঞ্জ বণিক সমিতি গত রোববার সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা দোকান-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। কেউ লুটপাট করতে এলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মানুষের এসব উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহ আলম জানান, তিনি এ বিষয়টি জানেন না। তবে জেলা প্রশাসন এমন যেকোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। প্রয়োজনে তাদের সহায়তা করা হবে।
জেলার পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমি এ উদ্যোগের বিষয়ে শুনিনি। গতকাল বিভাগীয় কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসেছিলেন। তাই পত্রিকা পড়ারও সময় পাইনি। না জেনে কোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়।’
শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব সময় সহিংসতার পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসেছে। এসে কিছু টিয়ার গ্যাস আর গুলি চালিয়ে চলে গেছে। তাঁরা বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশ্বাস দেওয়ার পরও শিবগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার কানসাটে অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের সদর দপ্তর ও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয় জামায়াত-শিবির। তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে ৪৮টি পরিবারকে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। এলাকার ১৫টি ইউনিয়ন এরপর থেকে বিদ্যুৎহীন হয়ে আছ। সেচের অভাবে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসলও নষ্ট হতে বসেছে। রাস্তা কেটে ও গাছ ফেলে গতকাল পর্যন্ত জামায়াত-শিবির শিবগঞ্জকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
মানুষের উদ্যোগ: কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানীর উদ্যোগে প্রথম শনিবার রাতে পুকুরিয়া গ্রামে তাঁর বাড়ির সামনে সর্বদলীয় সভা করেন পুকুরিয়া, বাগদীপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ। রোববারও একই ধরনের সভা হয় ছত্রজিৎপুর ইউনিয়নে। ছত্রজিৎপুর গোরস্থান আমবাগানে অনুষ্ঠিত সভায় শিবগঞ্জ পৌরসভা, ছত্রজিৎপুর, উজিরপুর ও নয়ালাভাঙা ইউনিয়নের ১০-১২টি গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ উপস্থিত হন। এই সভা থেকে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘ঐক্য কমিটি’ গঠন করা হয়। এই সভাগুলোর পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসে।
কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগের মধ্যেই রোববার রাতে নতুন আলীডাঙ্গা মন্দিরের অর্ধসমাপ্ত প্রতিমার খড়-বাঁশের কাঠামোতে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ ও সরস্বতী দেবীর প্রতিমা চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর ওই মন্দিরের পাশেই গতকাল সোমবার সভা ডাকে এলাকাবাসী। সভায় ২৭ সদস্যবিশিষ্ট ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। সভায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ সব দলের স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন শিবগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র) ঈমানী আলী। সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের আজিজুল হক, আমিনুল ইসলাম, বিএনপির আবু সাইয়ীদ, জামায়াতের সায়েদ ইসলাম, হান্নান আলী (্একটি মসজিদের ইমাম), মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার গড়গড়িয়া, ডা. কুশল কুমার বাইনধা, কমল কুমার ত্রিবেদী, কার্তিক সাহা প্রমুখ।
সভা শেষে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ঈমানী আলী প্রথম আলোকে বলেন, আলীডাঙা, চতুরপুর, তর্তিপুর এলাকায় চারটি মন্দির রয়েছে। এসব মন্দিরসহ এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে প্রতিদিন ১০০ যুবক পালা করে এলাকা পাহারা দেবেন। সোমবার রাত থেকেই পাহারা শুরু হয়েছে। 
এ ছাড়া গত রোববার রাতে শিবগঞ্জের শাহবাজপুর ইউনিয়নের নয়রশিয়া গ্রামে গ্রামবাসী শান্তি সভা করে। সেখানে নয়রশিয়া, নয়াগ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের এলাকার সহিংসতা বন্ধের জন্য ১১ সদস্যের ‘সর্বদলীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি’ করে। এখান থেকে এলাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষক ও বায়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে গঠিত হয়েছে একটি উপদেষ্টা কমিটি। এলাকায় বায়োজ্যেষ্ঠ হাজী নইমুদ্দীনের সভাপতিত্বে সভায় দুই গ্রামের সব দলের নেতা-কর্মীসহ গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও শাহবাজপুর সোনামসজিদ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল হক গতকাল প্রথম আলোকে জানান, সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এই দুই গ্রামের লোকজন নিজেরা তো সহিংসতায় জড়াবেনই না, অন্য কোনো জায়গায় সহিংসতায় অংশ নিতেও যাবেন না। সভায় উপস্থিত রাজনৈতিক দলের নেতারা গ্রামবাসীর কাছে অঙ্গীকার করেছেন, তাঁরা তাঁদের কর্মী ও অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ করবেন। 
সভায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হক, আস্তার আলী, আবদুল খালেক, বিএনপির আবদুল লতিফ, মোস্তাক আহমেদ, আলফাজ উদ্দীন, জামায়াতের আবুল কালাম আজাদ, আনারুল হক মাস্টারসহ স্থানীয় সাংবাদিক নূরতাজ আলী, অধ্যক্ষ হাদীকুল ইয়াজদানী, শাহবাজপুর সোনামসজিদ কলেজের শিক্ষক তহুরুল ইসলাম প্রমুখ। এর মধ্যে প্রথম আটজন ১১ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সদস্য। আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামে একই ধরনের সভা করে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে রোববার বিকেলে শিবগঞ্জ বণিক সমিতি ভবনের সামনে সমিতির সভাপতি এনামুল হকের সভাপতিত্বে সভা করেন ব্যবসায়ীরা। এনামুল হক গতকাল প্রথম আলোকে জানান, সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খোলা রাখবেন। এলাকায় লুটতরাজ হতে পারে বলে গুজব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করবে। দোকান খোলা রাখার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
মহাসমাবেশের উদ্যোগ: এলাকার কৃষক ও বিদ্যুৎ আন্দোলনের কর্মীদের নিয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধে মহাসমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানী। গতকাল তিনি বলেন, ২০০৬ সালে বিদ্যুতের জন্য এই এলাকায় আন্দোলন হয়েছে, ১৭ জন মানুষ জীবন দিয়েছেন। এখন বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়ে এলাকাকে বিদ্যুৎহীন করে রাখা হয়েছে। মানুষই আবার শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, হরতাল ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের পর এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী মহাসমাবেশ করা হবে। সে জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষক পর্যায়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment