Saturday, March 30, 2013

উন্নয়নের দিক থেকে অনুকরণীয় বাংলাদেশ


৭৮ শতাংশ দারিদ্রের হার নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। চার দশকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই হার নেমে এসেছে শতকরা তিরিশ ভাগে। নব্বই দশকের পর থেকে দারিদ্র বিমোচনের গতি হয়েছে দ্রুততর। এ কারণে অচিরেই বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।  

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মের পর পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল অধিক জনসংখ্যা আর খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে। এই দেশকে বলা হতো উন্নয়নের পরিক্ষাগার। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় মত ছিল, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে পৃথিবীর অন্য সব দেশে উন্নয়ন করা সম্ভব। কিন্তু চার দশকে এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন করেছে--বলেছেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।


১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের মানবউন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে ৮১.১ শতাংশ। একই সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মানবউন্নয়ন সূচকের উন্নতি হয়েছে যথাক্রমে ৬২.২, ৫৭.৬ ও ২৮.৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে গত নব্বই দশক থেকেই উন্নয়টা মূলত বেশি হয়েছে। এসময় জিডিপির হারসহ অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন হয়েছে। তবে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এগুলো মোকাবেলা করতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে উন্নত দেশে পরিণত সম্ভব বলেই মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৮২৮ ডলার। এখন তা প্রায় এক হাজার ডলার। এভাবে এগুতে থাকলে বাংলাদেশ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ‘মধ্যআয়ের দেশ’, ২০৩০ সালের মধ্যে ‘উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ’ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ‘পরিণত উন্নত অর্থনীতির দেশ’ এর মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।


বিধ্বস্ত দেশ থেকে উন্নতির পথে যাত্রা: নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে যায়। স্বাধীনতার পর দেশে ছিল না বৈদেশিক মুদ্রার কোন রিজার্ভ। বন্দর, পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প-কারখানা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। রপ্তানি বলতে ছিল পাট ও চা-এর মতো কয়েকটি পণ্য। আসতো না কোনো বৈদেশিক আয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। ডলারের হিসাবে জিডিপি বেড়েছে ১৮ গুণেরও চেয়েও বেশি। সত্তর ও আশির দশকে যেখানে জিডিপি'র গড় প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ১.১ ও ৩.২ শতাংশ সেখানে এই শতকের প্রথম দশকে (২০০০-১০) জিডিপি'র গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৮ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশ। চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সর্বশেষ বছরে ২০১৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে, যা গড় হিসাবে প্রতিবছর ৭.৩ শতাংশ। তবে পদ্মাসেতু নির্মাণ হলে জিডিপির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে অর্থনীতিবীদদের ধারণা।
তবে বাংলাদেশের এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা।

উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়, মানবিকও:  ভারতের তুলনায় মাথাপিছু আয় এখনও অর্ধেক হলেও বেশকিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভালো ফল অর্জন করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য, মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যা অনেক দেশই পারেনি। ২০১০-এ বাংলাদেশের সদ্যোজাত শিশু ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩.৮ ও ৪.৮ শতাংশ, যেখানে ভারতে এ হার ছিল যথাক্রমে ৪.৮ ও ৬.৩ শতাংশ।

১৯৯০-২০০৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মা-মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে ১৫৬ শতাংশ, একই সময়ে ভারতে হ্রাস পেয়েছে ১৪৮ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৬৯.৭ বছর, যেখানে ভারতের ৬৬.৮ বছর। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হারও ভারতের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে বাংলাদেশের ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ কম। বাংলাদেশে জন্মহার ভারতের চেয়ে কম এবং নারী শিক্ষার হার ভারতের চেয়ে বেশি। গণতান্ত্রিক সুশাসন এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা দেশ পরিচালনায় একটি বিরাট সাফল্য, যা আমাদের জনসাধারণের দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার ফসল। এ সমস্ত সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে বা তার আগেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)-এর অধিকাংশই অর্জনের সঠিক পথেই রয়েছে বলে আশা করা যায়। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে।

কৃষিতে সাফল্য আশাতীত: সাত কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনি বাংলাদেশ। বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো শক্তিও ছিল না এই দেশের। সাত কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হয়নি দেশে। ফলে স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে হয় বাংলাদেশকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ছিল বেশি

১৯৭২ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল বছরে এক কোটি টন। এখন তা তিন কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন এখন বাংলাদেশ চাল বিদেশে রপ্তানি করছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত অর্থবছরে দেশে ৩০ লাখ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত চাল উৎপাদিত হয়েছে।

আয়ের নতুন খাত: বর্তমানে বৈদেশিক আয়ের একটি উৎসে পরিণত হয়েছে সফটওয়্যার রপ্তানি। সফটওয়্যা রপ্তানির দিক থেকে সেরা ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে এই শিল্প আরও বিকশিত হবে বলেই মনে হয়।
আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পথে অনেক দূর এগিয়েছে দৃঢ় পদক্ষেপে, বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়েছে একটি উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতিতে একটি বিরাট রূপান্তর ঘটেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রায় অর্জন হয়েছে, কমেছে কৃষিনির্ভরতা, বেড়েছে শিল্প ও সেবা খাতের গুরুত্ব। তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের পরই পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান। জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, হাল্কা প্রকৌশল শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবাখাতও রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঢাকা টাইমসকে বলেন, স্বাধীনতার ৪২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোথায় এসেছে জিডিপির দিকে তাকালেই তা বুঝা যায়। এই সময়ে আমাদের অর্থনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তনও হয়েছে। কৃষির পাশাপাশি শিল্পখাত এগিয়েছে। অর্থনীতি এখন উৎপাদন খাত নির্ভর হয়েছে। রপ্তানি বেড়েছে, কমেছে আমদানি, রেমিটেন্স বেড়েছে, বৈদেশিক সাহায্য কমেছে ও অর্থনীতির আকারও বড় হয়েছে।

No comments:

Post a Comment