টিউডর বংশের যে রানি প্রথম এলিজাবেথকে এত দিন মহান সম্রাজ্ঞী হিসেবে
চিনে, জেনে, মেনে এসেছেন ব্রিটেনবাসী, তিনি নাকি পুরুষ। নিছক নিজেদের
গাফিলতি ঢাকতে এক সাদামাটা গ্রাম্য বালককে প্রথম এলিজাবেথ সাজিয়ে রাজা
অষ্টম হেনরির সামনে হাজির করেছিলেন তার দুই সভাসদ। সেই গ্রাম্য বালককেই এত
দিন ধরে প্রথম এলিজাবেথ হিসেবে জেনে এসেছে ব্রিটেন।
তাঁর নতুন উপন্যাস নিউ ইয়র্কের ব্যালান্টাইন বুকস থেকে প্রকাশিত ‘দ্য
কিংস ডিসেপশন’-এ এমনই দাবি করেছেন মার্কিন লেখক স্টিভ বেরি। এবং সেই দাবির
পক্ষে বক্তব্য, পুরুষ হওয়ার কারণেই কখনও বিয়ে করেননি ‘প্রথম এলিজাবেথ’।
ইতিহাস বলছে, ১৫৫৮ সালে সিংহাসনে বসার পর প্রথম এলিজাবেথ প্রতিজ্ঞা
করেছিলেন বিয়ে করবেন না। স্পেনের তৎকালীন শাসক তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে
বিয়ের প্রস্তাব পেড়েছিলেন এলিজাবেথের কাছে। কিন্তু রানি প্রত্যাখ্যান
করেন তা। এর পর স্পেনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
স্টিভের প্রশ্ন, বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করে যে যুদ্ধ অনায়াসেই এড়াতে পারতেন,
তাতে কেন জড়িয়ে পড়লেন রানি? পড়লেন, নিজের আসল পরিচয় ঢাকতে। যে পরিচয়
লুকিয়ে আছে দক্ষিণ পশ্চিম ব্রিটেনের গ্লস্টারশায়ার কাউন্টির ছোট্ট গ্রাম
কটসওল্ডে। এমনটাই দাবি ওই মার্কিন লেখকের।
স্টিভ লিখেছেন: সালটা ১৫৪৩। বছর দশেকের ছোট্ট এলিজাবেথ তখন কটসওল্ডে।
লন্ডনে প্লেগ ছড়িয়েছে। তাই মেয়েকে বাঁচাতে কটসওল্ডে পাঠিয়ে দিয়েছেন
রাজা অষ্টম হেনরী। বেশ কিছু দিন পরে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তিনি।
কিন্তু তার আগেই বিপর্যয়। রাজা আসার আগের দিন রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন
এলিজাবেথ। প্রথমে জ্বর, তার পর বমি, তড়কা। অসুস্থতা ক্রমেই বাড়ছে। পর দিন
সকালে মারাই গেলেন এলিজাবেথ। অষ্টম হেনরির কটসওল্ড পৌঁছতে তখন আর মাত্র
কয়েক ঘণ্টা বাকি।
প্রমাদ গুনলেন এলিজাবেথের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা লেডি ক্যাট
অ্যাশলে এবং টমাস প্যারি। এখন কী হবে! মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেলে রাজা
গর্দান তো নেবেনই, মারবেন দগ্ধে দগ্ধে। কারণ, এলিজাবেথকে রক্ষা করার ভার যে
তাঁদের উপরেই ছিল।
প্রাণ বাঁচাতে তাই ফন্দি আঁটলেন ক্যাট এবং টমাস। রাজার সঙ্গে যে তাঁর
মেয়ের দেখা সাক্ষাৎ বিশেষ হতো না, সে খবর জানা ছিল তাঁদের। এলিজাবেথ ছিলেন
অত্যন্ত লাজুক। তাঁর মায়ের গর্দান নিয়েছিলেন যে বাবা, তাঁর সঙ্গে কথাও
বলতেও ভয়ে কাঁপতেন তিনি।
তাই রাজার চোখে ধুলো দেওয়া যাবে মনে করে প্রথমে এলিজাবেথের মতো দেখতে
একটা মেয়ে জোগাড় করার চেষ্টা চালালেন ক্যাট ও টমাস। সম্ভবত খানিকটা সময়
কিনতে। যাতে রাজা বুঝে ওঠার আগে তাঁরা পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কপাল
মন্দ। কটসওল্ডে বাসিন্দার সংখ্যা বেশি নয়।
তেমন কোনও মেয়ে পাওয়া গেল না। তখন যা থাকে কপালে ভেবে গ্রামের এক
সাদামাটা বালক, নাম নেভিল, তাকেই এলিজাবেথ সাজিয়ে হাজির করলেন হেনরির
সামনে। আশ্চর্য এই যে, বাবাও বুঝতে পারলেন না, এ তাঁর মেয়ে নয়।
ক্যাট আর টমাস বুঝলেন, কেল্লা ফতে। স্বয়ং রাজাকে যখন ঠকানো গিয়েছে, তখন
বাকিরা কোন ছার! আর রাজবাড়ির কারও সঙ্গেই এলিজাবেথ বিশেষ কথার্বাতা বলতেন
না। ফলে আসল-নকলে কেউ ফারাক করতে পারবে না এমনটাই মনে হয়েছিল তাঁদের।
নেভিলের বদলে একটা মেয়ে জোগাড় করার চেষ্টা অবশ্য চালিয়েছিলেন
ক্যাট-টমাস। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ঠিক করলেন, নেভিলকে রাজকীয় আদবকায়দা
শিখিয়ে দেওয়াটাই নিজেদের পিঠ বাঁচানোর সব চেয়ে ভাল উপায়। স্টিভের দাবি,
কৌশলটা কাজে লেগে গিয়েছিল। শেষ দিন পর্যন্ত বিশেষ কেউ জানতে পারেননি
সত্যিটা।
খালি একজন ছাড়া। তিনি এলিজাবেথের চিফ মিনিস্টার উইলিয়াম সেসিল। সেসিল
অবশ্য শেষ দিন পর্যন্ত সেই রহস্য ফাঁস করেননি। স্টিভের মতে, এর কারণটা ছিল
এই যে, সত্যিটা ফাঁস হয়ে গেলে, ব্রিটেনে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত।
কারণ, টিউডর বংশের উত্তরাধিকারি হিসেবে তখন সে অর্থে সিংহাসনের আর কেউ
দাবিদার নেই। তাই বাধ্য হয়েই মুখ বন্ধ রেখেছিলেন সেসিল।
তার পর টেমস দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। চার শতকেরও বেশি সময় পুরনো সেই
সত্য যে গুটিকয় মানুষ জানতেন, মারা গিয়েছেন তাঁরাও। খালি কটসওল্ডে গুজব
আকারে কাহিনিটি ঘোরাফেরা করে। সেই গুজবের সূত্র ধরেই উপন্যাস লিখেছেন
স্টিভ। যদিও তাঁর দাবি, এ নিছক গল্প নয়। এ হল, রাজ ইতিহাসের প্রাচীনতম
চক্রান্ত। দেড় বছর নানা তথ্য ঘেঁটে যে চক্রান্তের রোমহর্ষক বিবরণ লিখেছেন
স্টিভ।
এলিজাবেথ যে আদতে পুরুষ ছিলেন তা বোঝাতে বেশ কিছু পরোক্ষ প্রমাণ তুলে
ধরেছেন ‘দ্য কিংস ডিসেপশন’-এর লেখক। বলেছেন, কটসওল্ড থেকে লন্ডনে ফেরার পর
যখন ফের লেখাপড়া শুরু করেন কিশোরী এলিজাবেথ, তখন তাঁর স্বভাব, আচরণের
পরিবর্তন দেখে প্রচণ্ড বিস্মিত হন তার গৃহশিক্ষক। এমনকী, নরম, পেলব
এলিজাবেথের শারীরিক গড়ন পাল্টে পুরুষালি হতে থাকে। এলিজাবেথের আগের ও পরের
ছবির মধ্যে সেই ফারাক স্পষ্ট।
কিন্তু এ সবই তো অনুমান। পাথুরে প্রমাণ জোগাড় করতে তাই স্টিভের দাবি,
অবিলম্বে খোঁড়া হোক প্রথম এলিজাবেথের কবর। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা হোক, তা
ছেলে না মেয়ের।
No comments:
Post a Comment