ছোটবেলায় একটা কৌতুক শুনতাম। কর্তা বাজারে যাচ্ছেন।
বাড়ির মুরব্বি শূন্যের দিকে তাকিয়ে অনির্দিষ্টভাবে বলছেন, পাঙাশ মাছ।
কর্তাও বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আরেক দিকে তাকিয়ে বললেন, পয়সা নাই।
পাঙাশ মাছ একটা সময় আমাদের কাছে খুবই একটা মহার্ঘ বস্তু ছিল। নদীতেই কেবল পাওয়া যেত। বাজারে তা ছিল সবচেয়ে দামি মাছ। এলাকার সবচেয়ে বড়লোকটিই কেবল তা কিনতে পারতেন। হয়তো তিনি ঠিকাদার, নয়তো তিনি কাস্টমস কর্তা, কিংবা তহশিলদার। সেই পাঙাশ মাছ এখন বাজারের সবচেয়ে অচ্ছুত মাছ। চাষের পাঙাশ। সবচেয়ে সস্তা। সস্তা বলেই হয়তো তার স্বাদ আর জিবে লাগে না। কী আশ্চর্য বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন আমাদের মৎস্যচাষিরা। বাজার চাষের মাছে সয়লাব। এখন বোয়াল থেকে শুরু করে ট্যাংরা পর্যন্ত চাষ হচ্ছে। চাষের কইয়ের আকার দেখলে ভিরমি খেতে হয়। কদিন পরে ইলিশ মাছও চাষ করা হবে। বাজার করতে গিয়ে আমরা এক হাতে পাতলুন টেনে ধরে, আরেক হাতে তর্জনী তুলে বলব, কী মিয়া, তোমার ইলিশ নদীর, নাকি চাষের?
বিপ্লব ঘটে গেছে পোলট্রিতে, বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগানো ৪০ বছর আগে অসম্ভব ছিল, এখন মুখের সংখ্যা দ্বিগুণ, জমি কমেছে সেই অনুপাতে; কিন্তু আমাদের চাষিরা সেটা বুঝতে দিলেন কই? প্রথম আলো লিখেছে, গত বছর চালের দাম কমেছে ৭ থেকে ১২ শতাংশ।
আমাদের বাল্যকালে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে লেখা ছিল, একটা পেয়ারার পুষ্টিগুণ ও খাদ্যগুণ একটা আপেলের চেয়েও বেশি। অথচ আমরা বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে আপেল কিনে খাই। পেয়ারা কেউ কিনে খায় না। সেই দিন আর নেই। আমি দুটো পেয়ারা কিনেছি ১৭০ টাকায়। আপেল এর চেয়ে ঢের সস্তা। আর কী সে পেয়ারা! এমন সুস্বাদ। আমাদের চাষিরা এই পেয়ারা ফলাচ্ছেন। আর আমাদেরও সামর্থ্য হয়েছে ১৭০ টাকায় দুটো পেয়ারা কেনার।
সামর্থ্যের কথায় একটু পরে আসছি। আগে নীরবে এই দেশের সাধারণ মানুষ যে কী অসাধারণ সব কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, সে প্রসঙ্গে আরও দুটো কথা বলে নিই। কাপড়চোপড়ও এখন ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই, বিশেষ করে তৈরি পোশাক। বিদেশে তো আমরা রপ্তানি করিই, ওতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় হয়, কিন্তু দেশের মানুষও কি সস্তায় টি-শার্ট থেকে জিনসের প্যান্ট পরছে না? আর আছেন আমাদের অভিবাসীরা। কষ্ট করে বিদেশে যান, বিদেশে গিয়েও কষ্ট করেন, কিন্তু দেশে ডলার তাঁরা পাঠিয়েই চলেছেন।
আবার ছোটবেলার কথা বলতে হয়। কী যেন একটা বইয়ে একটা বাক্য পড়েছিলাম, ছোট্ট সুই থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ, সবই এই দেশে আমদানি করতে হয়। এখন এই বাক্য আমরা উল্টো করে লিখতে পারি, ছোট্ট জামা থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ, সবই এই দেশে তৈরি হয় আর রপ্তানি হয়।
এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এই দেশে, এর পেছনে বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যদি বলেন, আমার সরকারের নীতি কি কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যের পেছনে ভূমিকা পালন করছে না? আমাদের নিশ্চয়ই বলতে হবে, হ্যাঁ, করছে।
আর আছে সেই সব সাফল্য—আমরা টিকাদানের কর্মসূচিতে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছি। আমরা নারী ও শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পেরেছি। আমাদের ৯৫ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, পোশাক কারখানার মেয়েরা মধ্যরাতেও দল বেঁধে বাড়ি ফিরছে, মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে মেয়েরা কাজ করছে। এসবের পেছনে প্রতিটি সরকারের নীতি ও কর্মতৎপরতা নিশ্চয়ই অবদান রেখেছে।
এবং ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেই চলেছে। শেয়ার মার্কেট খালি করে নিয়ে গেল প্রীতিধন্য দস্যুরা, সরকারি ব্যাংক খালি করে নিয়ে গেল কোথাকার কোন তানভীর, ঘুষের টাকা নিয়ে ধরা পড়েন মন্ত্রীর পিএস, দুর্নীতি কমিশন ধরে নিয়ে যায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্তাদের, তবু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তো খারাপ না। এসব চুরি-চামারি না হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে যেত, আরেকটু ধাক্কা দিয়ে সেটাকে ১০-এ নিয়ে গেলেই তো গন্তব্যরেখার লাল ফিতাটাকে ছুঁয়ে ফেলে বিজয়স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আমরা ভি চিহ্ন দেখাতে পারতাম!
আচ্ছা, এই যে হাজার কোটি টাকা চুরি করা হয়, এগুলো কই রাখা হয়? বস্তায় করে নিশ্চয়ই কেউ টাকা রাখে না। সহজ হিসাব, বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ট্রাংকে করে নয়, আমদানির নামে, দাম বেশি দেখিয়ে। আহা রে! আমার অভিবাসী ভাইটি মরুভূমিতে শরীর পুড়িয়ে, পূর্ব এশিয়ায় গরু-ছাগলের মতো এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাত্রিযাপন করে দেশে ডলার পাঠায় আর নির্লজ্জ দস্যুসর্দারেরা সেসব পাচার করে দেয় আর বড় বড় কথা বলে। শিশুদের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে উপদেশ দেয়, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।
তবু এই দেশের উন্নতি হচ্ছেই। এত লুট, এত ঘুষ, এত দুর্নীতি, তবুও।
এই উন্নতির মূলে এই দেশের মানুষ। আর মানুষকে এই সুযোগ দিয়েছে গণতন্ত্র। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো কোনো সরকারই কেড়ে নেয়নি, মাঝেমধ্যে ধমকটমক দিয়ে, মাঝেমধ্যে দু-চার ঘা বসিয়ে দিয়ে খানিকটা দমন করা গেছে, কিন্তু সংবাদমাধ্যম মোটের ওপর স্বাধীন। ওই নব্বইয়ের পর থেকেই। তারও একটা সুফল আছে। তানভীর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েই। আবুল হোসেনকে বিদায় নিতেই হয় এবং যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
আমাদের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, আমাদের কৃষি, মৎস্য, তৈরি পোশাক, অভিবাসনশিল্পে বিপ্লব আমাদের দিয়েছে সামর্থ্য। এখন আমরা আর পাঙাশ মাছ খেতে চাই না। চাষের কই মাছ বলে ভুরু কোঁচকাই। হঠাৎ করে বাংলাদেশের তরুণেরা যে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল, দুজন ছেলে এভারেস্টে ওঠে তো দুজন মেয়েও উঠে দেখিয়ে দিল, এই দেশ নারী-পুরুষের সাম্যের দেশ, তার পেছনেও আছে আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য। এভারেস্টে ওঠার জন্য একজন লাখ চল্লিশেক টাকা নির্বাহ করতে পারে। গত বছর বিপিএল খেলে নাসিরের পাওয়ার কথা ছিল দেড় কোটি টাকা, তিনি ৬০ লাখ টাকা পেয়েছেন, এবার তাঁকে কেনা হয়েছে দুই কোটি টাকায়। বলা হচ্ছে, এবার পুরো টাকাই তিনি পাবেন। ঢাকা কিংবা কক্সবাজারের আকাশরেখা বদলে গেল কাচের ভবনে সূর্য কিংবা চাঁদের আলোর ঝলকানিতে আর বিপিএলে কোটি কোটি টাকার ঝনঝনানি—এসবই আমাদের সামর্থ্য বাড়ার প্রমাণ।
কাজেই গুপ্ত বাবুদের বিড়াল সাদা হোক আর কালো হোক, আবুলরা একজন হোন আর দুজন হোন, আমরা এগিয়ে চলেছি! এটাকেই বোধ হয় বিদেশি অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন বাংলাদেশ প্যারাডক্স। এত অপশাসন, এত দুর্নীতি, এত অযোগ্যতা সত্ত্বেও দেশটা এগোচ্ছে কী করে? বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মাথা চুলকান। আমাদের সহজ উত্তর, গণতন্ত্র আর মানুষ—এই হলো আমাদের উন্নতির মূলে।
৩১ ডিসেম্বরের পত্রিকাগুলোর দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। গত বছরটা কেমন গেল, কার্টুনে, আলোকচিত্রে, প্রবন্ধে, নিবন্ধে সব কাগজই তা একনজরে দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সত্যি, ২০১২-তে এই দেশে বড় বেশি অঘটন ঘটেছে। এবং এই সব অঘটনের বেশির ভাগই, বলতে গেলে সবই, মনুষ্য-সৃষ্ট। কাজেই আজকে, পয়লা জানুয়ারির সকালবেলা, আমরা বরং নতুন আশায় বুক বাঁধি। গত বছরের কেলেঙ্কারি, ব্যর্থতা, বিয়োগব্যথা ২০১২-এর সঙ্গে বিদায় নিক। ২০১৩ আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক।
২০১৩ সালে এই দেশের মানুষের প্রধান দুশ্চিন্তা, নির্বাচনের বছর, কীভাবে নির্বাচন হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, তা স্থির হয়নি। ২০১৩-য় কি আমরা রাস্তায় শুধু মারামারি করব, বলি হবে নিরীহ নির্বিবাদী বিশ্বজিৎরা।
আজকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের সকালবেলা একটা কথা বলে রাখি, ২০১৩ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না, বাংলাদেশের মানুষের এক আশ্চর্য সৃজনশীলতা আছে, নেতারা সংকট সৃষ্টি করেন, প্যাঁচ খেলতে গিয়ে কঠিন গিট্টু বাঁধিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই দেশের সৃজনশীল মানুষ নতুন কোনো সৃজনশীলতা দেখিয়ে একটা চমৎকার সমাধানও ঠিকই বের করে ফেলে। এবারও আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পাব।
শুধু একটা জিনিস চোখের মণির মতো আমাদের রক্ষা করে যেতে হবে, আর তা হলো গণতন্ত্র।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
বাড়ির মুরব্বি শূন্যের দিকে তাকিয়ে অনির্দিষ্টভাবে বলছেন, পাঙাশ মাছ।
কর্তাও বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আরেক দিকে তাকিয়ে বললেন, পয়সা নাই।
পাঙাশ মাছ একটা সময় আমাদের কাছে খুবই একটা মহার্ঘ বস্তু ছিল। নদীতেই কেবল পাওয়া যেত। বাজারে তা ছিল সবচেয়ে দামি মাছ। এলাকার সবচেয়ে বড়লোকটিই কেবল তা কিনতে পারতেন। হয়তো তিনি ঠিকাদার, নয়তো তিনি কাস্টমস কর্তা, কিংবা তহশিলদার। সেই পাঙাশ মাছ এখন বাজারের সবচেয়ে অচ্ছুত মাছ। চাষের পাঙাশ। সবচেয়ে সস্তা। সস্তা বলেই হয়তো তার স্বাদ আর জিবে লাগে না। কী আশ্চর্য বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন আমাদের মৎস্যচাষিরা। বাজার চাষের মাছে সয়লাব। এখন বোয়াল থেকে শুরু করে ট্যাংরা পর্যন্ত চাষ হচ্ছে। চাষের কইয়ের আকার দেখলে ভিরমি খেতে হয়। কদিন পরে ইলিশ মাছও চাষ করা হবে। বাজার করতে গিয়ে আমরা এক হাতে পাতলুন টেনে ধরে, আরেক হাতে তর্জনী তুলে বলব, কী মিয়া, তোমার ইলিশ নদীর, নাকি চাষের?
বিপ্লব ঘটে গেছে পোলট্রিতে, বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগানো ৪০ বছর আগে অসম্ভব ছিল, এখন মুখের সংখ্যা দ্বিগুণ, জমি কমেছে সেই অনুপাতে; কিন্তু আমাদের চাষিরা সেটা বুঝতে দিলেন কই? প্রথম আলো লিখেছে, গত বছর চালের দাম কমেছে ৭ থেকে ১২ শতাংশ।
আমাদের বাল্যকালে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে লেখা ছিল, একটা পেয়ারার পুষ্টিগুণ ও খাদ্যগুণ একটা আপেলের চেয়েও বেশি। অথচ আমরা বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে আপেল কিনে খাই। পেয়ারা কেউ কিনে খায় না। সেই দিন আর নেই। আমি দুটো পেয়ারা কিনেছি ১৭০ টাকায়। আপেল এর চেয়ে ঢের সস্তা। আর কী সে পেয়ারা! এমন সুস্বাদ। আমাদের চাষিরা এই পেয়ারা ফলাচ্ছেন। আর আমাদেরও সামর্থ্য হয়েছে ১৭০ টাকায় দুটো পেয়ারা কেনার।
সামর্থ্যের কথায় একটু পরে আসছি। আগে নীরবে এই দেশের সাধারণ মানুষ যে কী অসাধারণ সব কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন, সে প্রসঙ্গে আরও দুটো কথা বলে নিই। কাপড়চোপড়ও এখন ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই, বিশেষ করে তৈরি পোশাক। বিদেশে তো আমরা রপ্তানি করিই, ওতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় হয়, কিন্তু দেশের মানুষও কি সস্তায় টি-শার্ট থেকে জিনসের প্যান্ট পরছে না? আর আছেন আমাদের অভিবাসীরা। কষ্ট করে বিদেশে যান, বিদেশে গিয়েও কষ্ট করেন, কিন্তু দেশে ডলার তাঁরা পাঠিয়েই চলেছেন।
আবার ছোটবেলার কথা বলতে হয়। কী যেন একটা বইয়ে একটা বাক্য পড়েছিলাম, ছোট্ট সুই থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ, সবই এই দেশে আমদানি করতে হয়। এখন এই বাক্য আমরা উল্টো করে লিখতে পারি, ছোট্ট জামা থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ, সবই এই দেশে তৈরি হয় আর রপ্তানি হয়।
এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এই দেশে, এর পেছনে বাংলাদেশের মানুষের সৃজনশীলতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যদি বলেন, আমার সরকারের নীতি কি কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যের পেছনে ভূমিকা পালন করছে না? আমাদের নিশ্চয়ই বলতে হবে, হ্যাঁ, করছে।
আর আছে সেই সব সাফল্য—আমরা টিকাদানের কর্মসূচিতে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছি। আমরা নারী ও শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পেরেছি। আমাদের ৯৫ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, পোশাক কারখানার মেয়েরা মধ্যরাতেও দল বেঁধে বাড়ি ফিরছে, মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে মেয়েরা কাজ করছে। এসবের পেছনে প্রতিটি সরকারের নীতি ও কর্মতৎপরতা নিশ্চয়ই অবদান রেখেছে।
এবং ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেই চলেছে। শেয়ার মার্কেট খালি করে নিয়ে গেল প্রীতিধন্য দস্যুরা, সরকারি ব্যাংক খালি করে নিয়ে গেল কোথাকার কোন তানভীর, ঘুষের টাকা নিয়ে ধরা পড়েন মন্ত্রীর পিএস, দুর্নীতি কমিশন ধরে নিয়ে যায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্তাদের, তবু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তো খারাপ না। এসব চুরি-চামারি না হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে যেত, আরেকটু ধাক্কা দিয়ে সেটাকে ১০-এ নিয়ে গেলেই তো গন্তব্যরেখার লাল ফিতাটাকে ছুঁয়ে ফেলে বিজয়স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আমরা ভি চিহ্ন দেখাতে পারতাম!
আচ্ছা, এই যে হাজার কোটি টাকা চুরি করা হয়, এগুলো কই রাখা হয়? বস্তায় করে নিশ্চয়ই কেউ টাকা রাখে না। সহজ হিসাব, বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ট্রাংকে করে নয়, আমদানির নামে, দাম বেশি দেখিয়ে। আহা রে! আমার অভিবাসী ভাইটি মরুভূমিতে শরীর পুড়িয়ে, পূর্ব এশিয়ায় গরু-ছাগলের মতো এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাত্রিযাপন করে দেশে ডলার পাঠায় আর নির্লজ্জ দস্যুসর্দারেরা সেসব পাচার করে দেয় আর বড় বড় কথা বলে। শিশুদের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে উপদেশ দেয়, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।
তবু এই দেশের উন্নতি হচ্ছেই। এত লুট, এত ঘুষ, এত দুর্নীতি, তবুও।
এই উন্নতির মূলে এই দেশের মানুষ। আর মানুষকে এই সুযোগ দিয়েছে গণতন্ত্র। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো কোনো সরকারই কেড়ে নেয়নি, মাঝেমধ্যে ধমকটমক দিয়ে, মাঝেমধ্যে দু-চার ঘা বসিয়ে দিয়ে খানিকটা দমন করা গেছে, কিন্তু সংবাদমাধ্যম মোটের ওপর স্বাধীন। ওই নব্বইয়ের পর থেকেই। তারও একটা সুফল আছে। তানভীর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েই। আবুল হোসেনকে বিদায় নিতেই হয় এবং যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
আমাদের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, আমাদের কৃষি, মৎস্য, তৈরি পোশাক, অভিবাসনশিল্পে বিপ্লব আমাদের দিয়েছে সামর্থ্য। এখন আমরা আর পাঙাশ মাছ খেতে চাই না। চাষের কই মাছ বলে ভুরু কোঁচকাই। হঠাৎ করে বাংলাদেশের তরুণেরা যে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল, দুজন ছেলে এভারেস্টে ওঠে তো দুজন মেয়েও উঠে দেখিয়ে দিল, এই দেশ নারী-পুরুষের সাম্যের দেশ, তার পেছনেও আছে আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য। এভারেস্টে ওঠার জন্য একজন লাখ চল্লিশেক টাকা নির্বাহ করতে পারে। গত বছর বিপিএল খেলে নাসিরের পাওয়ার কথা ছিল দেড় কোটি টাকা, তিনি ৬০ লাখ টাকা পেয়েছেন, এবার তাঁকে কেনা হয়েছে দুই কোটি টাকায়। বলা হচ্ছে, এবার পুরো টাকাই তিনি পাবেন। ঢাকা কিংবা কক্সবাজারের আকাশরেখা বদলে গেল কাচের ভবনে সূর্য কিংবা চাঁদের আলোর ঝলকানিতে আর বিপিএলে কোটি কোটি টাকার ঝনঝনানি—এসবই আমাদের সামর্থ্য বাড়ার প্রমাণ।
কাজেই গুপ্ত বাবুদের বিড়াল সাদা হোক আর কালো হোক, আবুলরা একজন হোন আর দুজন হোন, আমরা এগিয়ে চলেছি! এটাকেই বোধ হয় বিদেশি অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন বাংলাদেশ প্যারাডক্স। এত অপশাসন, এত দুর্নীতি, এত অযোগ্যতা সত্ত্বেও দেশটা এগোচ্ছে কী করে? বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মাথা চুলকান। আমাদের সহজ উত্তর, গণতন্ত্র আর মানুষ—এই হলো আমাদের উন্নতির মূলে।
৩১ ডিসেম্বরের পত্রিকাগুলোর দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। গত বছরটা কেমন গেল, কার্টুনে, আলোকচিত্রে, প্রবন্ধে, নিবন্ধে সব কাগজই তা একনজরে দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সত্যি, ২০১২-তে এই দেশে বড় বেশি অঘটন ঘটেছে। এবং এই সব অঘটনের বেশির ভাগই, বলতে গেলে সবই, মনুষ্য-সৃষ্ট। কাজেই আজকে, পয়লা জানুয়ারির সকালবেলা, আমরা বরং নতুন আশায় বুক বাঁধি। গত বছরের কেলেঙ্কারি, ব্যর্থতা, বিয়োগব্যথা ২০১২-এর সঙ্গে বিদায় নিক। ২০১৩ আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক।
২০১৩ সালে এই দেশের মানুষের প্রধান দুশ্চিন্তা, নির্বাচনের বছর, কীভাবে নির্বাচন হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, তা স্থির হয়নি। ২০১৩-য় কি আমরা রাস্তায় শুধু মারামারি করব, বলি হবে নিরীহ নির্বিবাদী বিশ্বজিৎরা।
আজকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের সকালবেলা একটা কথা বলে রাখি, ২০১৩ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না, বাংলাদেশের মানুষের এক আশ্চর্য সৃজনশীলতা আছে, নেতারা সংকট সৃষ্টি করেন, প্যাঁচ খেলতে গিয়ে কঠিন গিট্টু বাঁধিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই দেশের সৃজনশীল মানুষ নতুন কোনো সৃজনশীলতা দেখিয়ে একটা চমৎকার সমাধানও ঠিকই বের করে ফেলে। এবারও আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পাব।
শুধু একটা জিনিস চোখের মণির মতো আমাদের রক্ষা করে যেতে হবে, আর তা হলো গণতন্ত্র।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment