২০০৭ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন তাঁরা সাক্ষাৎ করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে, যিনি মাস দুয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দল বিএনপি ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দুই দল যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি। রাজনৈতিক অচলাবস্থায় দেশের অর্থনীতি পর্যুদস্ত, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ জনসাধারণ বীতশ্রদ্ধ। দুই কূটনীতিকের লক্ষ্য চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে দুই নেত্রীকে রাজি করানো।
একই উদ্দেশ্যে বিউটেনিস এর আগেও খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন একাধিকবার। কিন্তু উভয় নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকেছেন এবং বিউটেনিসের কাছে পরস্পর সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। ২০০৬ সালের ২৯ নভেম্বর বিউটেনিস মোরশেদ খান, মান্নান ভূঁইয়া ও রিয়াজ রহমানের উপস্থিতিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনের যে রূপরেখা দিয়েছে, তা নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর মতো মার্কিন দূতাবাসও উদ্বিগ্ন। বিউটেনিস খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘এটা খুব স্পষ্ট, সাবেক ক্ষমতাসীন দল (বিএনপি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার (ইয়াজউদ্দিন) ওপর প্রবল প্রভাব খাটিয়ে চলেছে। একটি সফল নির্বাচনের পথে বিদ্যমান সুস্পষ্ট বাধা-বিপত্তিগুলো দূর করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষভাবে বা বিচার-বিবেচনার সঙ্গে কাজ করছে না।’ বিউটেনিসের এই কথা শুনে খালেদা জিয়া তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিলেন, ‘আপনারা কূটনীতিকেরা সবাই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন!’ খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের তিন নেতা একযোগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পুরোনো সমালোচনার পুনরাবৃত্তি করেন: ‘আওয়ামী লীগ সহিংস, প্রতিহিংসাপরায়ণ, বিশ্বাস ভঙ্গকারী দল; এই দলকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করা যায় না।’
নভেম্বরের ২৯ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৭ তারিখ পর্যন্ত রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং দুই প্রতিপক্ষ দলের অবস্থান আরও কঠোর, আরও অনড় হয়েছে। ৭ জানুয়ারি বিউটেনিস ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে আবার গেলেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন মোরশেদ খান, মান্নান ভূঁইয়া ও রিয়াজ রহমান। দুই কূটনীতিকের অনুরোধে খালেদা জিয়া ওই তিন নেতাকে কিছু সময় বৈঠকের বাইরে রাখেন। পরে তাঁরা ফিরে আসেন নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে।
২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি পাঠানো বিউটেনিসের লেখা একটি গোপন তারবার্তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিনের বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার খালেদা জিয়াকে একান্তে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু সদস্য তাঁদের কাছে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সুপারিশ করেছেন, যার ফলে খালেদা জিয়া ও তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা বিদেশে রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে বাধ্য হবেন, সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটবে, সম্ভবত সামরিক আইন জারি হবে বা অভ্যুত্থান ঘটবে।
এসব কথা শুনে খালেদা জিয়া রেগে যান। সামরিক বাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো কাজ করবে—এমন ধারণা তিনি ক্রুদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বরং পাল্টা অভিযোগ করেন, এ ধরনের গুঞ্জনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং এ দেশের নাগরিক সমাজের নেতারা।
খালেদা জিয়ার এই অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে নাকচ করে দেন বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী। তাঁরা তাঁকে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওই নেতাদের প্রস্তাবে তাঁরা সমর্থন বা উৎসাহ জোগাননি; বরং অনড়ভাবে ক্রমাগত সামরিক বাহিনীর যেকোনো ধরনের অসাংবিধানিক ভূমিকার বিরোধিতা করে এসেছেন। বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী খালেদা জিয়াকে আরও বলেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এ কারণে যে এই খবরগুলোর প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করা তাঁদের কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। তাঁরা খালেদা জিয়াকে জানান, আগের দিন ৬ জানুয়ারি তাঁরা শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন একই উদ্দেশ্যে, তাঁকেও তাঁরা একই বার্তা জানিয়েছেন।
বিউটেনিসের ৯ জানুয়ারির তারবার্তাটির ভাষ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়া তাঁর ও আনোয়ার চৌধুরীর কাছে স্বীকার করেন যে বিএনপির মধ্যে ‘কিছু মতভিন্নতা আছে’। খালেদা জিয়া তাঁদের বলেন, বিএনপির কিছু নেতা সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সংক্ষোভের যুক্তি খারিজ করে দিয়ে বলেন, দলের মনোনয়ন বা পদ-পদবি না পেয়ে ওই নেতারা তাঁর ওপর সংক্ষুব্ধ হয়েছেন।
কিন্তু সেনাবাহিনী ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতে পারে, অভ্যুত্থান বা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে, এমনকি তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা করতে পারে—এ রকম ধারণা খালেদা জিয়ার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি দুই কূটনীতিককে বলেন, ‘তাঁর’ সেনাবাহিনী তাঁর ‘অবাধ্য’ হবে না। বিউটেনিস ওই তাঁরবার্তার শেষে মন্তব্য অংশে লিখেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনার কথা শুনে খালেদা জিয়া যে এ রকম প্রতিক্রিয়াই দেখাবেন, সেটা বিউটেনিস আগেই ধারণা করেছিলেন।
বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য দুই নেত্রীর সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুই কূটনীতিক বিএনপির চেয়ারপারসনকে বলেন, এমন একটি রাজনৈতিক সমঝোতা নিশ্চিতভাবেই সম্ভব, যার ফলে দেশ সহিংসতা থেকে রক্ষা পাবে এবং সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটতে যাচ্ছে ইত্যাদি জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে। তখন খালেদা জিয়া ঝট করে উত্তর দেন, ‘আমরা তো সব সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ করতে চাই। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না।’
খালেদা জিয়া দুই কূটনীতিককে বলেন, তিনি সব সময়ই চেয়েছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার্থে ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন করতেই হবে—এ অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসা এখন আর সম্ভব নয়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। খালেদা মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে আশ্বাস দেন, বিএনপি নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ভোটার পরিচয়পত্র তৈরিসহ নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়ন করবে এবং ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে আবার নতুন করে নির্বাচন দেবে। খালেদা জিয়া স্বীকার করেন যে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী সরকার বৈধ বলেই বিবেচিত হবে।
রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস খালেদা জিয়াকে বলেন, শুধু বিএনপির অংশগ্রহণে একতরফা নির্বাচন হলে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই মনে করবে যে তাদের একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপি দেশ পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম হবে কি না—বিউটেনিস এই প্রশ্ন করলে খালেদা জিয়া হেসে এমন ধারণা উড়িয়ে দেন যে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের ৪০ শতাংশের সমর্থন আছে। খালেদা মনে করেন না যে আওয়ামী লীগ গণবিক্ষোভ চালিয়ে যেতে পারবে।
বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরীর সঙ্গে ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার বৈঠকে হাসিনা যেভাবে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপস-সমঝোতার পরামর্শ নাকচ করে দেন, ৭ জানুয়ারি তাঁদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে খালেদাও একইভাবে এমন পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস পরদিন ৮ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ রহমানের সঙ্গে। বিউটেনিসের উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়াকে আবারও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জানানো যে দুই দলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন। রিয়াজ রহমান বিউটেনিসকে নিশ্চিত করেন, খালেদা জিয়া বিউটেনিসের ‘বার্তা পেয়েছেন’। কিন্তু খালেদা জিয়া ও বিএনপি মনে করে, ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন স্থগিত করা, জরুরি অবস্থা ও সামরিক হস্তক্ষেপ—এই তিন ধরনের সম্ভাবনার মধ্যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করাই বিএনপির জন্য ‘সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হবে’।
৯ জানুয়ারির তারবার্তার মন্তব্য অংশে রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস তাঁর সদর দপ্তরকে জানাচ্ছেন, তাঁর বার্তার প্রতি খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া ‘শ্যুট দ্য মেসেঞ্জার’ প্রবাদের মতো। অর্থাৎ খালেদার মেজাজ এখন এমন যে তাঁকে যে ব্যক্তি খারাপ সংবাদ দেবে, তিনি তাকেই গুলি করবেন। তাই তাঁর দলের লোকজন তাঁকে খারাপ সংবাদ জানাতে ভয় পাচ্ছেন। বিউটেনিস আরও লিখছেন, ‘আমরা এখনো সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের কথা শুনতে পাচ্ছি।...আমাদের বলা হচ্ছে, একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বিস্মিত হয়েছে।’
একই উদ্দেশ্যে বিউটেনিস এর আগেও খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন একাধিকবার। কিন্তু উভয় নেত্রী নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকেছেন এবং বিউটেনিসের কাছে পরস্পর সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। ২০০৬ সালের ২৯ নভেম্বর বিউটেনিস মোরশেদ খান, মান্নান ভূঁইয়া ও রিয়াজ রহমানের উপস্থিতিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনের যে রূপরেখা দিয়েছে, তা নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোর মতো মার্কিন দূতাবাসও উদ্বিগ্ন। বিউটেনিস খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘এটা খুব স্পষ্ট, সাবেক ক্ষমতাসীন দল (বিএনপি) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার (ইয়াজউদ্দিন) ওপর প্রবল প্রভাব খাটিয়ে চলেছে। একটি সফল নির্বাচনের পথে বিদ্যমান সুস্পষ্ট বাধা-বিপত্তিগুলো দূর করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষভাবে বা বিচার-বিবেচনার সঙ্গে কাজ করছে না।’ বিউটেনিসের এই কথা শুনে খালেদা জিয়া তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিলেন, ‘আপনারা কূটনীতিকেরা সবাই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন!’ খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের তিন নেতা একযোগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পুরোনো সমালোচনার পুনরাবৃত্তি করেন: ‘আওয়ামী লীগ সহিংস, প্রতিহিংসাপরায়ণ, বিশ্বাস ভঙ্গকারী দল; এই দলকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করা যায় না।’
নভেম্বরের ২৯ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৭ তারিখ পর্যন্ত রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং দুই প্রতিপক্ষ দলের অবস্থান আরও কঠোর, আরও অনড় হয়েছে। ৭ জানুয়ারি বিউটেনিস ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে আবার গেলেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন মোরশেদ খান, মান্নান ভূঁইয়া ও রিয়াজ রহমান। দুই কূটনীতিকের অনুরোধে খালেদা জিয়া ওই তিন নেতাকে কিছু সময় বৈঠকের বাইরে রাখেন। পরে তাঁরা ফিরে আসেন নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে।
২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি পাঠানো বিউটেনিসের লেখা একটি গোপন তারবার্তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিনের বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার খালেদা জিয়াকে একান্তে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কিছু সদস্য তাঁদের কাছে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সুপারিশ করেছেন, যার ফলে খালেদা জিয়া ও তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা বিদেশে রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে বাধ্য হবেন, সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটবে, সম্ভবত সামরিক আইন জারি হবে বা অভ্যুত্থান ঘটবে।
এসব কথা শুনে খালেদা জিয়া রেগে যান। সামরিক বাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো কাজ করবে—এমন ধারণা তিনি ক্রুদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বরং পাল্টা অভিযোগ করেন, এ ধরনের গুঞ্জনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং এ দেশের নাগরিক সমাজের নেতারা।
খালেদা জিয়ার এই অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে নাকচ করে দেন বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী। তাঁরা তাঁকে বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওই নেতাদের প্রস্তাবে তাঁরা সমর্থন বা উৎসাহ জোগাননি; বরং অনড়ভাবে ক্রমাগত সামরিক বাহিনীর যেকোনো ধরনের অসাংবিধানিক ভূমিকার বিরোধিতা করে এসেছেন। বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী খালেদা জিয়াকে আরও বলেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এ কারণে যে এই খবরগুলোর প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করা তাঁদের কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। তাঁরা খালেদা জিয়াকে জানান, আগের দিন ৬ জানুয়ারি তাঁরা শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন একই উদ্দেশ্যে, তাঁকেও তাঁরা একই বার্তা জানিয়েছেন।
বিউটেনিসের ৯ জানুয়ারির তারবার্তাটির ভাষ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়া তাঁর ও আনোয়ার চৌধুরীর কাছে স্বীকার করেন যে বিএনপির মধ্যে ‘কিছু মতভিন্নতা আছে’। খালেদা জিয়া তাঁদের বলেন, বিএনপির কিছু নেতা সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সংক্ষোভের যুক্তি খারিজ করে দিয়ে বলেন, দলের মনোনয়ন বা পদ-পদবি না পেয়ে ওই নেতারা তাঁর ওপর সংক্ষুব্ধ হয়েছেন।
কিন্তু সেনাবাহিনী ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতে পারে, অভ্যুত্থান বা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে, এমনকি তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা করতে পারে—এ রকম ধারণা খালেদা জিয়ার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি দুই কূটনীতিককে বলেন, ‘তাঁর’ সেনাবাহিনী তাঁর ‘অবাধ্য’ হবে না। বিউটেনিস ওই তাঁরবার্তার শেষে মন্তব্য অংশে লিখেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনার কথা শুনে খালেদা জিয়া যে এ রকম প্রতিক্রিয়াই দেখাবেন, সেটা বিউটেনিস আগেই ধারণা করেছিলেন।
বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য দুই নেত্রীর সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুই কূটনীতিক বিএনপির চেয়ারপারসনকে বলেন, এমন একটি রাজনৈতিক সমঝোতা নিশ্চিতভাবেই সম্ভব, যার ফলে দেশ সহিংসতা থেকে রক্ষা পাবে এবং সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটতে যাচ্ছে ইত্যাদি জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে। তখন খালেদা জিয়া ঝট করে উত্তর দেন, ‘আমরা তো সব সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ করতে চাই। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না।’
খালেদা জিয়া দুই কূটনীতিককে বলেন, তিনি সব সময়ই চেয়েছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার্থে ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন করতেই হবে—এ অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসা এখন আর সম্ভব নয়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। খালেদা মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে আশ্বাস দেন, বিএনপি নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ভোটার পরিচয়পত্র তৈরিসহ নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়ন করবে এবং ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে আবার নতুন করে নির্বাচন দেবে। খালেদা জিয়া স্বীকার করেন যে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী সরকার বৈধ বলেই বিবেচিত হবে।
রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস খালেদা জিয়াকে বলেন, শুধু বিএনপির অংশগ্রহণে একতরফা নির্বাচন হলে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই মনে করবে যে তাদের একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপি দেশ পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম হবে কি না—বিউটেনিস এই প্রশ্ন করলে খালেদা জিয়া হেসে এমন ধারণা উড়িয়ে দেন যে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের ৪০ শতাংশের সমর্থন আছে। খালেদা মনে করেন না যে আওয়ামী লীগ গণবিক্ষোভ চালিয়ে যেতে পারবে।
বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরীর সঙ্গে ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার বৈঠকে হাসিনা যেভাবে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপস-সমঝোতার পরামর্শ নাকচ করে দেন, ৭ জানুয়ারি তাঁদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকে খালেদাও একইভাবে এমন পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস পরদিন ৮ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ রহমানের সঙ্গে। বিউটেনিসের উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়াকে আবারও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জানানো যে দুই দলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন। রিয়াজ রহমান বিউটেনিসকে নিশ্চিত করেন, খালেদা জিয়া বিউটেনিসের ‘বার্তা পেয়েছেন’। কিন্তু খালেদা জিয়া ও বিএনপি মনে করে, ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন স্থগিত করা, জরুরি অবস্থা ও সামরিক হস্তক্ষেপ—এই তিন ধরনের সম্ভাবনার মধ্যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করাই বিএনপির জন্য ‘সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হবে’।
৯ জানুয়ারির তারবার্তার মন্তব্য অংশে রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস তাঁর সদর দপ্তরকে জানাচ্ছেন, তাঁর বার্তার প্রতি খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া ‘শ্যুট দ্য মেসেঞ্জার’ প্রবাদের মতো। অর্থাৎ খালেদার মেজাজ এখন এমন যে তাঁকে যে ব্যক্তি খারাপ সংবাদ দেবে, তিনি তাকেই গুলি করবেন। তাই তাঁর দলের লোকজন তাঁকে খারাপ সংবাদ জানাতে ভয় পাচ্ছেন। বিউটেনিস আরও লিখছেন, ‘আমরা এখনো সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের কথা শুনতে পাচ্ছি।...আমাদের বলা হচ্ছে, একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বিস্মিত হয়েছে।’
No comments:
Post a Comment