মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
শুভেচ্ছা জানবেন। খুব বিপন্ন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লিখছি আজ। আমাদের দেশ আজ ‘পুরুষ’ সেজে থাকা কিছু বর্বরের চারণভূমি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর আমাদের মতো নির্বোধ জনগণ নিতান্ত নপুংশকের মতো তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সবই জানেন আশা করি, দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়নি। তবে এগুলো বাদ দিয়ে অন্য একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। অনুরোধ করতে চাই, একজন ভবিষ্যতের ধর্ষককে এখনই থামান।
আমরা জানি, আপনি অনলাইন গণমাধ্যগুলোতে নিয়মিত চোখ রাখেন। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে একটি মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার ভান করে ফুল হাতে এগিয়ে যাওয়ার পর সজোরে চড় মারার যে ভিডিও ক্লিপটি কয়েকদিন আগে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, সেটিও নিশ্চয়ই আপনার চোখ এড়ায়নি। এই ঘটনার মূল নায়ক সৃজন আহমেদ, ভিডিওটি ধারণ করেছে তার সহপাঠী শিবলি রহমান শিপু, আর সম্প্রতি ফেসবুকে এটি ছড়িয়েছে মাসুদ রানা নামের আর একজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পুরো বিষয়টি একদিকে যেমন লজ্জার, একদিকে যেমন ঘটনাটি আমাদের ক্রোধান্বিত করে, অন্যদিকে প্রচণ্ড আতঙ্কও গ্রাস করে আমাদের।
প্রথমত, ঘটনাটি মনুষ্যত্বের চরম অবমাননার একটি দৃষ্টান্ত। আমরা যারা সকল মানুষের সমতার কথা বলি, লিঙ্গভিত্তিক অথবা অন্যান্য বৈষম্যের ঊর্দ্ধে উঠে একটি সুষম মানব সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করি তাদের সেই প্রত্যাশা হোঁচট খায় এরকম ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে।কারণটি খুব সহজ, যখন আমরা নারী-পুরুষ বিভাজনকে বাতিল করে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি তখন সৃজন আহমেদরা একজন নারীর নারীত্বকে অপমান করার চেষ্টা করেছে। শুধু জন্মগতভাবে একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের হওয়াতেই এই অপমান। বস্তুত এটি নারীত্বের অপমান নয়, বরং মানবিকতার যে সর্বজনীন সৌন্দর্য তারই অবমাননা। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হিসেবে এই ঘটনায় আমরা বিপন্নবোধ করি।
দ্বিতীয়ত, ঘটনাটি একটি স্কুলের ক্লাসরুমে ঘটেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আমাদের চিন্তার কাঠামো দান করা, আর এর প্রথম ধাপটা হলো স্কুল। সেই স্কুলের একটি ক্লাসরুমে এই ঘটনা ঘটেছে, ভিডিও করা হয়েছে, সেটি প্রচারও করা হয়েছে। তাহলে আমাদের চেতনা গঠনের জায়গাগুলো কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে? স্কুলের ছাত্ররা যদি তাদের চোখের সামনে এসব ঘটনা দেখে বড় হয়ে ওঠে তাহলে এই জাতির ভবিষ্যৎ কতখানি অন্ধকার হয়ে যেতে পারে! তার চেয়েও বড় আশঙ্কার কথা হলো, ক্লাসরুমের অন্যান্য ছাত্ররা তো বটেই, স্কুল কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে কোন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। স্থানীয়ভাবে একটি শালিস করে মিটিমাট করা হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশে যখন এ ব্যাপারে স্পষ্ট নীতিমালা ও আইন আছে তখন এরকম ‘মিটমাটের চেষ্টা’ আমাদের আতঙ্কিত করে।
তৃতীয়ত, এই ঘটনাটির মাধ্যমে দু’টি মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটি হলো শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে নারী নির্যাতন বা আরো স্পষ্ট ভাবে বললে যৌন হয়রানি। অন্যটি হলো মানহানিকর একটি ভিডিও অনলাইন মাধ্যমে প্রচার করার মাধ্যমে সাইবার অপরাধ। দু’টি ব্যাপারেই বাংলাদেশে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। এখন যদি এই ঘটনাটি বিচারহীনতার বিবরে বিলীন হয় তাহলে তা হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠান পথে একটি বড় কলঙ্কজনক অধ্যায়।
চতুর্থত, এরকম একটি ঘটনার এমন প্রচার নতুন প্রজন্মের কিশোরদেরও মনেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যখনই তারা দেখবে শুধু ‘পুরুষ’ হওয়ার জোরেই একজন ‘নারীর’ উপর যাচ্ছেতাই নির্যাতন করা যায় তখন তাদের কেউ কেউ আবারও এমন কাজ করতে উৎসাহী হবে। যখনই তারা দেখবে এসব ঘটনার বিচার হচ্ছে না, তখনই তারা আবার মানবিকতার অপমান করার চেষ্টা করবে। আমরা নিশ্চয়ই চাই না আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি নারীবিদ্বেষী প্রজন্ম হিসেবে বড় হয়ে উঠুক।
পঞ্চমত, এই সৃজন আহমেদ, শিবলি কিংবা মাসুদ রানার মতো মানুষেরাই আগামী দিনে ধর্ষক হয়ে উঠবে। স্কুল জীবনেই যারা এমন মারাত্মক একটি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা পরবর্তী জীবনে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও কলুষিত করবে, আর কিছু নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সর্বোচ্চ অভিভাবক আপনি। তেমন একজন নাগরিক হিসেবে, একজন আতঙ্কিত, বিপন্ন নাগরিক হিসেবে আপনার কাছে এই চিঠি লিখছি। আমাদের সমতাকে, মনুষ্যত্বকে, নারী-পুরুষের বৈষম্যের ঊর্দ্ধে উঠে পরিপূর্ণ মানুষ হবার চেষ্টাকে রক্ষা করুন। একজন সৃজন আহমেদ জন্ম দিতে পারে আরো কয়েক শত সৃজন আহমেদের। কাজেই এখনই সময় এই ঘৃণ্য নারী নির্যাতনকারীকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর। এব্যাপারে আপনার সচেতন হস্তক্ষেপ আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার এই প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী সাধারন নাগরিক হিসেবে আপনার কাছে এই দাবি রাখছি। যে বিপন্নতায় আজ আমরা ডুবে যাচ্ছি, সেখান থেকে আমাদের তুলে নিয়ে আসার কাজটুকুও আপনাকেই করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সৃজন আহমেদদের এখনই থামান।
ভালো থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুভেচ্ছা আবারও।
ইতি
বাংলাদেশের নিম্নসাক্ষরকারী নাগরিকবৃন্দ
No comments:
Post a Comment