আমাদের আদি ফসলের মধ্যে ধান একটি।এই ধান নিয়েই কাজ কারবার বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের। এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান মেটাচ্ছে আমাদের খাদ্য ঘাটতি। গাজীপুরে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানের নানা আবিষ্কার নিয়েই আমাদের এবারের মূল রচনা।
নাম তার পঙ্খিরাজ। শরীর কালচে বাদামি রঙের। দুই পাশে হালকা সাদা অবয়ব দেখলে পাখার মতো মনে হবে। তবে এটি রূপকথার ডানাওয়ালা ‘পঙ্খিরাজ ঘোড়া’ নয়, এটি একটি দেশি ধানের জাত। সিলেট, নেত্রকোনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে আমন মৌসুমে এই ধানের চাষ হতো। কৃষকের সঙ্গে মন-কষাকষি হলে এ ধান উড়ে চলে যেত সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। অন্য কোনো অচিন ঠিকানায়। এমন বিশ্বাস থেকে সিলেটের লালেং আদিবাসীরা এই ধানকে ডাকে ‘পাখবিরণ’।
ধান নিয়ে এমন হাজারো ইতিহাস বাংলার জীবন ও রূপকথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুণ, বৈশিষ্ট্য, সমাজ আর ইতিহাস প্রতিটি ধানের নামের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বিশ্বের ধান চাষের আদি ভূমি এই বাংলায় একসময় অঞ্চলভেদে সহস্রাধিক জাতের ধানের চাষ হতো। জল-কাদায় গড়া এই বঙ্গীয় বদ্বীপে ধানের জাতের নাম তাই হয়েছে জলকুমারী, মধুমালা, জলকাদা, খেজুরঝুপি, তুলসীমালা, জামাই পাগল প্রভৃতি। কোনোটা খরা, কোনোটা বন্যা, আবার কোনোটা শীত ও লবণাক্ততা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। ১৯৮২ সালে ধানবিজ্ঞানী জে পি হেক্টর জরিপ করে দেখতে পেয়েছিলেন, ওই সময় বাংলাদেশে ১২ হাজার ৪৮৭ প্রজাতির ধানের জাত ছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জার্মপ্লাজম সংরক্ষণকেন্দ্রে আছে প্রায় আট হাজার জাতের দেশীয় ধান।
দেশীয় ধানের জাত নিয়ে অনেক লোকশ্রুতি বাংলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে এসব লোকশ্রুতি নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকেরা বিস্মিত হলেও হতে পারেন। কিন্তু এসব দেশীয় জাত থেকে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধান বিশ্ববাসীর কাছে সত্যিই আশ্চর্য ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। ২০১২ সালের জাতিসংঘের কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বে একরপ্রতি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণায় খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য বিস্ময়কর হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর্ন্তজাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থা (ইফপ্রি) বলছে, বিশ্বের দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে আদর্শ রাষ্ট্র।
ধানের কারিগর: কিন্তু কী করে এল এই সাফল্য। ১৯৭০ সালে যে দেশের ধানের উৎপাদন ছিল সাকল্যে এক কোটি টন, ১৯৭৪ সালে যে দেশকে বিশ্বের একটি প্রভাবশালী দেশের এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিলেন, ২০১৩ সালে এসে সেই একই দেশে চালের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে চার কোটি টনে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশকে চাল আমদানি করতে হয়নি; বরং সুগন্ধি চাল রপ্তানি করেছে। যাঁরা একসময় এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিলেন, তাঁরাই ২০১৩ সালে এসে এ দেশকে বলছেন উপচে পড়া খাদ্যের দেশ।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে হাইব্রিড ও জিনগতভাবে পরিবর্তিত (জিএম) জাতের বেশি ভূমিকা রয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, যেখানে দেশীয় জাত থেকে উফশী জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছে। বন্ধা নয়, অর্থাৎ ধান থেকে বীজ-ধান হয়, এমন ৬৪টি জাতের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ১০টি জাত।
বিশ্বের বিস্ময়: নিত্যনতুন জাত আবিষ্কারের এই অভিযানে হাজার বছর ধরে কৃষকের ঘরে ঘরে সংরক্ষণ করা জাতগুলো রসদ জুগিয়েছে। আমাদের দেশি জাতের অনেক উপাদান আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জাত উদ্ভাবনেও সহযোগিতা দিচ্ছে। ধান চাষের আঁতুড়ঘর এই দেশেরই একটি জাতের বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ইরি উদ্ভাবিত আইআই-৮ জাতটি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি দেশি জাতের জিন বা কৌলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো হয়েছিল।
সিলেট অঞ্চলের অতিপরিচিত ধান কাচালত নিয়ে বিশ্বের ধানবিজ্ঞানীরা অভিভূত হয়ে গেছেন। ফসফরাস কম, এমন মাটিতে চাষের উপযোগী জাত উদ্ভাবনে কাচালত ধানের জিন বা কৌলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মেগা জাত বা হাইব্রিডের মতোই বেশি উৎপাদন হয় এমন জাত বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ বিশ্বের ধানবিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছে। বোরো মৌসুমে শুধু এই জাত দেশের প্রায় অর্ধেক চাল জোগান দিচ্ছে। আমাদের দেশি জাত বাদশাভোগ থেকে একটি বিশুদ্ধ লাইন নিয়ে বিআর-২৮ ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছিল। জলসহিষ্ণু ধানের জাত বিআর-২৩-ও উদ্ভাবন করা হয়েছে সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে নেওয়া একটি দেশীয় জাত থেকে।
এখন যেমন ধান-চালকে শুধু ক্ষুধা নিবারণের পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, আগে কিন্তু তেমনটা ছিল না। ধান একই সঙ্গে ওষুদের কাজও করত। হাল আমলে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে এসব বিষয় প্রমাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলের দেশি জাতের সুগন্ধি চাল খেলে আর্সেনিকের ঝুঁকি কমে আসে। দেশি জাত দুলাভোগ ধানে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। এই রাসায়নিক পদার্থ চালের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে শরীরে কোষগুলো সজীব থাকে। এই জাতের ধান খেলে ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে আসে। বিজ্ঞানীরা দেশীয় কয়েকটি জাত থেকে গবেষণা করে বিআর-২৫ ও বিআর-১৬ জাত উদ্ভাবন করেছেন। এই জাতের চাল ডায়াবেটিস রোগীদের উপযোগী হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এখন শুধু খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে, এমন জাত এখন দরকার। ব্রির বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন। তাঁরা জিংক ও আয়রনসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করে চলেছেন। সিলেট অঞ্চলের দেশীয় জাত পশুশাইল থেকে জিন নিয়ে ঠান্ডা-সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে। সেদিন হয়তো দূরে নয়, বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে ধানের আদি ভূমি হওয়ার পাশাপাশি নিত্যনতুন ধানের, আধুনিক জাতের ধানের জনকের দেশ হিসেবেও পরিচিত পাবে।
উফশী ধানের আঁতুড়ঘর
রাজধানীর অদূরেই গাজীপুরে ব্রির প্রধান কার্যালয়টিকে এ দেশের বিজ্ঞানীরা নিত্যুনতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। গবেষণাকেন্দ্রের ভেতরেই রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেখানে শতাধিক নতুন জাত উদ্ভাবনের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। আট হাজার দেশি জাত সংরক্ষণের জন্য রয়েছে একটি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণাগার।
১৯৭০ সালের ১ অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার ধান গবেষণার জন্য বরিশাল, লবণাক্ত এলাকার জন্য সাতক্ষীরা, খরাপ্রবণ এলাকার জন্য রাজশাহী, ঠান্ডাপ্রবণ ও জলাবদ্ধ এলাকার জন্য রংপুর, গভীর পানির ধান গবেষণার জন্য হবিগঞ্জ ও ভাঙ্গা, উপকূলীয় এলাকার জন্য সোনাগাজী এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য কুমিল্লা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের ১৮টি গবেষণা বিভাগ, ১১টি প্রশাসনিক শাখা ও বিভাগ এবং দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ৭৫টি টেস্ট সাইট রয়েছে।
ব্রিতে এখন ১৯২ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। ইরি, বিলস অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি), জার্মান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁদের সঙ্গে কাজ করছে।
ব্রি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে এফএওর বিশেষ সম্মাননা, ইরি থেকে বিশেষ সম্মাননা ও সেনাধরা অ্যাওয়ার্ড এবং দেশের মধ্যে স্বাধীনতা দিবস পদক দুবার, জাতীয় পরিবেশ পদক, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড, প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পেয়েছে। ২০০৮ সালে ব্রি পায় গণিত অলিম্পিয়াড পুরস্কার।
নাম তার পঙ্খিরাজ। শরীর কালচে বাদামি রঙের। দুই পাশে হালকা সাদা অবয়ব দেখলে পাখার মতো মনে হবে। তবে এটি রূপকথার ডানাওয়ালা ‘পঙ্খিরাজ ঘোড়া’ নয়, এটি একটি দেশি ধানের জাত। সিলেট, নেত্রকোনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে আমন মৌসুমে এই ধানের চাষ হতো। কৃষকের সঙ্গে মন-কষাকষি হলে এ ধান উড়ে চলে যেত সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। অন্য কোনো অচিন ঠিকানায়। এমন বিশ্বাস থেকে সিলেটের লালেং আদিবাসীরা এই ধানকে ডাকে ‘পাখবিরণ’।
ধান নিয়ে এমন হাজারো ইতিহাস বাংলার জীবন ও রূপকথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুণ, বৈশিষ্ট্য, সমাজ আর ইতিহাস প্রতিটি ধানের নামের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বিশ্বের ধান চাষের আদি ভূমি এই বাংলায় একসময় অঞ্চলভেদে সহস্রাধিক জাতের ধানের চাষ হতো। জল-কাদায় গড়া এই বঙ্গীয় বদ্বীপে ধানের জাতের নাম তাই হয়েছে জলকুমারী, মধুমালা, জলকাদা, খেজুরঝুপি, তুলসীমালা, জামাই পাগল প্রভৃতি। কোনোটা খরা, কোনোটা বন্যা, আবার কোনোটা শীত ও লবণাক্ততা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। ১৯৮২ সালে ধানবিজ্ঞানী জে পি হেক্টর জরিপ করে দেখতে পেয়েছিলেন, ওই সময় বাংলাদেশে ১২ হাজার ৪৮৭ প্রজাতির ধানের জাত ছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জার্মপ্লাজম সংরক্ষণকেন্দ্রে আছে প্রায় আট হাজার জাতের দেশীয় ধান।
দেশীয় ধানের জাত নিয়ে অনেক লোকশ্রুতি বাংলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে এসব লোকশ্রুতি নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকেরা বিস্মিত হলেও হতে পারেন। কিন্তু এসব দেশীয় জাত থেকে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধান বিশ্ববাসীর কাছে সত্যিই আশ্চর্য ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। ২০১২ সালের জাতিসংঘের কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বে একরপ্রতি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণায় খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য বিস্ময়কর হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর্ন্তজাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা সংস্থা (ইফপ্রি) বলছে, বিশ্বের দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে আদর্শ রাষ্ট্র।
ধানের কারিগর: কিন্তু কী করে এল এই সাফল্য। ১৯৭০ সালে যে দেশের ধানের উৎপাদন ছিল সাকল্যে এক কোটি টন, ১৯৭৪ সালে যে দেশকে বিশ্বের একটি প্রভাবশালী দেশের এক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিলেন, ২০১৩ সালে এসে সেই একই দেশে চালের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে চার কোটি টনে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশকে চাল আমদানি করতে হয়নি; বরং সুগন্ধি চাল রপ্তানি করেছে। যাঁরা একসময় এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিলেন, তাঁরাই ২০১৩ সালে এসে এ দেশকে বলছেন উপচে পড়া খাদ্যের দেশ।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে হাইব্রিড ও জিনগতভাবে পরিবর্তিত (জিএম) জাতের বেশি ভূমিকা রয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, যেখানে দেশীয় জাত থেকে উফশী জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছে। বন্ধা নয়, অর্থাৎ ধান থেকে বীজ-ধান হয়, এমন ৬৪টি জাতের ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ১০টি জাত।
বিশ্বের বিস্ময়: নিত্যনতুন জাত আবিষ্কারের এই অভিযানে হাজার বছর ধরে কৃষকের ঘরে ঘরে সংরক্ষণ করা জাতগুলো রসদ জুগিয়েছে। আমাদের দেশি জাতের অনেক উপাদান আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জাত উদ্ভাবনেও সহযোগিতা দিচ্ছে। ধান চাষের আঁতুড়ঘর এই দেশেরই একটি জাতের বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ইরি উদ্ভাবিত আইআই-৮ জাতটি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি দেশি জাতের জিন বা কৌলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো হয়েছিল।
সিলেট অঞ্চলের অতিপরিচিত ধান কাচালত নিয়ে বিশ্বের ধানবিজ্ঞানীরা অভিভূত হয়ে গেছেন। ফসফরাস কম, এমন মাটিতে চাষের উপযোগী জাত উদ্ভাবনে কাচালত ধানের জিন বা কৌলিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মেগা জাত বা হাইব্রিডের মতোই বেশি উৎপাদন হয় এমন জাত বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ বিশ্বের ধানবিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছে। বোরো মৌসুমে শুধু এই জাত দেশের প্রায় অর্ধেক চাল জোগান দিচ্ছে। আমাদের দেশি জাত বাদশাভোগ থেকে একটি বিশুদ্ধ লাইন নিয়ে বিআর-২৮ ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছিল। জলসহিষ্ণু ধানের জাত বিআর-২৩-ও উদ্ভাবন করা হয়েছে সাতক্ষীরা অঞ্চল থেকে নেওয়া একটি দেশীয় জাত থেকে।
এখন যেমন ধান-চালকে শুধু ক্ষুধা নিবারণের পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, আগে কিন্তু তেমনটা ছিল না। ধান একই সঙ্গে ওষুদের কাজও করত। হাল আমলে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে এসব বিষয় প্রমাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলের দেশি জাতের সুগন্ধি চাল খেলে আর্সেনিকের ঝুঁকি কমে আসে। দেশি জাত দুলাভোগ ধানে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। এই রাসায়নিক পদার্থ চালের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে শরীরে কোষগুলো সজীব থাকে। এই জাতের ধান খেলে ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে আসে। বিজ্ঞানীরা দেশীয় কয়েকটি জাত থেকে গবেষণা করে বিআর-২৫ ও বিআর-১৬ জাত উদ্ভাবন করেছেন। এই জাতের চাল ডায়াবেটিস রোগীদের উপযোগী হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এখন শুধু খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে, এমন জাত এখন দরকার। ব্রির বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন। তাঁরা জিংক ও আয়রনসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করে চলেছেন। সিলেট অঞ্চলের দেশীয় জাত পশুশাইল থেকে জিন নিয়ে ঠান্ডা-সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে। সেদিন হয়তো দূরে নয়, বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে ধানের আদি ভূমি হওয়ার পাশাপাশি নিত্যনতুন ধানের, আধুনিক জাতের ধানের জনকের দেশ হিসেবেও পরিচিত পাবে।
উফশী ধানের আঁতুড়ঘর
রাজধানীর অদূরেই গাজীপুরে ব্রির প্রধান কার্যালয়টিকে এ দেশের বিজ্ঞানীরা নিত্যুনতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। গবেষণাকেন্দ্রের ভেতরেই রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সেখানে শতাধিক নতুন জাত উদ্ভাবনের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। আট হাজার দেশি জাত সংরক্ষণের জন্য রয়েছে একটি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণাগার।
১৯৭০ সালের ১ অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার ধান গবেষণার জন্য বরিশাল, লবণাক্ত এলাকার জন্য সাতক্ষীরা, খরাপ্রবণ এলাকার জন্য রাজশাহী, ঠান্ডাপ্রবণ ও জলাবদ্ধ এলাকার জন্য রংপুর, গভীর পানির ধান গবেষণার জন্য হবিগঞ্জ ও ভাঙ্গা, উপকূলীয় এলাকার জন্য সোনাগাজী এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য কুমিল্লা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের ১৮টি গবেষণা বিভাগ, ১১টি প্রশাসনিক শাখা ও বিভাগ এবং দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ৭৫টি টেস্ট সাইট রয়েছে।
ব্রিতে এখন ১৯২ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। ইরি, বিলস অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিষয়ক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি), জার্মান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁদের সঙ্গে কাজ করছে।
ব্রি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে এফএওর বিশেষ সম্মাননা, ইরি থেকে বিশেষ সম্মাননা ও সেনাধরা অ্যাওয়ার্ড এবং দেশের মধ্যে স্বাধীনতা দিবস পদক দুবার, জাতীয় পরিবেশ পদক, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড, প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পেয়েছে। ২০০৮ সালে ব্রি পায় গণিত অলিম্পিয়াড পুরস্কার।
No comments:
Post a Comment