Monday, April 22, 2013

লাগাতার আড্ডা

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফি। হুট করেই এক সহপাঠীকে ভালো লেগেছিল। দীর্ঘদিন ধরে সাহস সঞ্চয় করে যখনই তাঁকে মনের কথা বলবেন ভাবছেন, তখনই সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। রাফির তখন পুরোই দেবদাস দশা। জীবনের আবহ সংগীতে বাজে বেহালার করুণ সুর! পড়ায় মন বসে না, কিছু ভালো লাগে না। ‘একদিন বন্ধুরা ঠিক করল, রাতে সবাই একসঙ্গে থাকবে। আমিও থাকলাম। রাতের আড্ডায় কথায় কথায় ওরা ধরে বসল, তোর সমস্যা কী? তুই এত চুপচাপ কেন? আমতা আমতা করে বলেই ফেললাম। তাতেই বাধল বিপত্তি। সান্ত্বনা তো দিলই না, উল্টো শুরু হলো খেপানো! রাতভর আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা... ভোরের দিকে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, আমিও ওদের সঙ্গে হাসাহাসি শুরু করেছি! পরদিন কোথায় হতাশা, কোথায় ক্লান্তি! একদম ঝরঝরা লাগছিল!’ বলছিলেন রাফি।
বন্ধুদের আড্ডাটাই এমন। ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা যতই ঘিরে ধরুক, একটা নির্মল আড্ডায় যেন সব কর্পূরের মতো উবে যায়! ক্লাস আর কাজের ফাঁকে আড্ডা তো আছেই, রাতের আড্ডাটা তরুণদের বিশেষ পছন্দ। পরীক্ষা শেষ, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না কিংবা দীর্ঘদিন পর বিলেত থেকে দেশে ফিরেছে এক বন্ধু্—উপলক্ষ একটা পেলেই হলো। রাত জেগে গল্পটা করতেই হবে। কেউ কেউ আবার উপলক্ষের থোড়াই কেয়ার করেন। ‘বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেব, তার আবার উপলক্ষ কী!’
স্কুলের বন্ধু, পাড়ার বন্ধু, কলেজের বন্ধু—বন্ধুর দল থাকে অনেক। তবে রাতের আড্ডার ‘প্রবেশপত্র’ পায় কেবল কাছের বন্ধুরাই। রিয়াজুল আমিন বলছিলেন, ‘মাঝেমধ্যেই সবাই মিলে বন্ধুদের কারও না কারও বাসায় হানা দিই। রাতের আড্ডায় বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়। বোঝাপড়াটা বাড়ে। অনেক না-বলা কথা বলা হয়ে যায়। দেশ, সমাজ নিয়ে কথা হয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয়।’
সব সময় যে আড্ডাটা ‘নির্মল’ হয়, তা না। কখনো কখনো ক্ষণিকের উত্তেজনা কিংবা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তরুণেরা ভুল করে বসেন, আর সেই ভুলের মাশুল দিতে হয় পুরো পরিবারকে। বাবা-মায়ের ভয়টা এখানেই। ছেলের আনন্দে বাদ সাধতে মন চায় না, আবার দুশ্চিন্তাও হয়। এ সমস্যা দূর করতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। কথা হলো মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘যখন তরুণ ছিলাম, আমরাও রাতে বন্ধুর বাসায় থেকেছি, আড্ডা দিয়েছি।’ বাবা-মায়ের শঙ্কা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সন্তানের ওপর আস্থা তৈরি করাটা খুব জরুরি। সন্তানেরও উচিত বাবা-মায়ের আস্থার মর্যাদা দেওয়া। সন্তানের বন্ধু হতে হবে। তরুণেরা জানে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ।’ 
কমলাপুরের অধিবাসী নাজমা আক্তার। ছেলে শরীফ ছোটবেলা থেকেই বন্ধুপ্রিয়। প্রায়ই ছেলের বন্ধুরা দল বেঁধে হানা দেয় তাঁর বাসায়। ‘আমার ছেলের বন্ধুদের আমি চিনি। ওদের পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমি জানি, ওরা ভালো ছেলে। ওরা এলে আমারও খুব ভালো লাগে। ওদের জন্য কী রাঁধব, কী খাওয়াব—এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। আবার ওরাও খেয়াল রাখে, যেন আমার কষ্ট না হয়।’
আড্ডার আনন্দ তো হবেই, সঙ্গে বাবা-মা যেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, সে দায়িত্বও নিতে হবে তরুণদের। কিছু ব্যাপার বিবেচনা করা জরুরি।
 বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধুদের সুসম্পর্ক থাকতে হবে।
 পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তোলার দায়িত্ব সন্তান এবং বাবা-মা উভয়েরই। বাবা-মায়ের যেমন অতিরিক্ত সন্দেহ করাটা উচিত নয়, তেমনি সন্তানকেও বাবা-মায়ের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। বন্ধুদের ফোন নম্বর বাবা মায়ের কাছে দিয়ে রাখতে হবে, বিপদ-আপদে দরকার হতেই পারে।
 বন্ধুর বাড়িতে গেলে অবশ্যই মা-বাবাকে জানাতে হবে। ফোন বন্ধ করে রাখা কিংবা যোগাযোগ না করাটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
 বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে তাঁদের যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারটাও খেয়াল রাখতে হবে।
 হুট করে রাতের বেলা বন্ধুদের গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়া উচিত নয়।
 কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে কোনো প্রকার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
 অবশ্যই পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে হবে। বাবা-মা যেমন ছেলের আনন্দটা বুঝবেন, তেমনি সন্তানকেও মা-বাবাকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। 
আড্ডা হবে। আনন্দ হবে। মনের ঘুড়ি উড়বে আকাশে, তবে নাটাইটা যেন হাতে থাকে!

No comments:

Post a Comment