তাজরীনে এক কর্মীর লাশ |
যুক্ত করুন |
মাত্র ৩৭ ডলারে আস্ত মানুষ! এত সস্তায় কাবাব আর কোথায়? বিদেশে এক প্লেট মাংসের ডিনার ১০০ ডলার। চায়না-ভারত তাদের কাবাবের দাম মজুরপ্রতি ৪০ ডলার বাড়িয়ে দেয়ায় পশ্চিমের বিলিয়নিয়ার রক্তচোষারা দলে দলে ঢাকা ছুটছেন বাংলাদেশকে এক নম্বর বানাতে। কয়েক প্লেট খেয়ে ফেললেও বদহজম হয় না। পাঁচ তারকা হোটেলে বসে মাল খেতে খেতে চুক্তি হবে, যেন ছালা গেলেও আম থাকে। যত দিন পর্যন্ত অমানবিক মূল্যে গরিব নারীদের ব্যবহার করা সম্ভব তত দিন পর্যন্ত রক্তচোষারা নো-কমপ্লায়েন্স কোম্পানিকেই কাজ দেবে। আর যারা এই কাবাব হয়, তাদের জীবন পশুর চেয়েও মূল্যহীন।
এত কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী, আসল কথাটি লুকিয়ে গেলেন। সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক। বিজেএমইএ ও এফবিসিসিআই পার্টির বড় অঙ্কের ডোনার। ‘ষড়যন্ত্র’ হোক কিন্তু জোনিং রেগুলেশনের কী হবে? কমপ্লায়েন্সের কী হবে? মালিকের দায়দায়িত্ব কী? গার্মেন্টের পাশে বাড়িঘর উঠল কেন? ফ্যাক্টরিতে নিরাপদ বহির্গমনের সিঁড়ি ছিল না কেন? মুখরা প্রধানমন্ত্রী এর একটি প্রশ্নও তোলেননি। মালিক যেকোনো ভবন ভাড়া নিতে পারে। কিন্তু একে গার্মেন্ট উপযোগী করার দায়িত্ব গার্মেন্ট মালিকদের এবং কমপ্লায়েন্সের সার্টিফিকেট দেবে রাজউক ও ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এবং অন্যান্য এজেন্সি। ‘ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র’ বলে প্রধানমন্ত্রীর চিৎকার অমতার লণ। বরং মানুষ উত্তেজিত করা বক্তব্য থেকে এবার থামতে হবে। নাশকতার চেয়েও বড় অপরাধ করেছে ফ্যাক্টরির মালিক ও সরকার। তিনতলা ভবন কিনে রাজউকের অনুমতি ছাড়াই নয়তলা বানিয়েছে ঋণখেলাপি দেলোয়ার। যদি দেলোয়ার অবৈধ গোডাউন না বানাত ও বহির্গমনের সিঁড়ি কোডমাফিক করত একজন মানুষও মরত কি না সন্দেহ। সাফাই গাওয়া বিজিএমইএ নো-কমপ্লায়েন্স সত্ত্বেও জেনেশুনে তাজরীনকে দিয়েছে কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট। আমাদের প্রশ্ন, মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে ব্যবসায় করা কি বিজিএমইএ-এর গণতান্ত্রিক অধিকার হয়ে গেছে? নিউ ইয়র্ক টাইমস সেপ্টেম্বর ২ তারিখে এদের চরিত্রের ওপর সামান্য আলোকপাত করে লিখেছে, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ বানিয়ে সরকার শ্রমিকদের দাবিদাওয়া প্রতিহত করছে, গার্মেন্টের মালিকেরা সরকারের ডোনার। হামীম গ্র“পের মালিক ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট এবং দু’টি মিডিয়ার মালিক, সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, শ্রমিক অসন্তোষ ঠেকাতে মিডিয়াকে ব্যবহার করে।’ শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম গুম হওয়ার পরিপ্রেেিত এই লেখা, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিহত করার নেপথ্যের কাহিনী উঠে এসেছে। ফ্যাক্টরির ভেতরে ট্রাক বোঝাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ দেখে আমি নিজেও শঙ্কিত হয়েছিলাম। জানলাম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশদের কাজ যখন-তখন শ্রমিক অসন্তোষ প্রতিহত করা।
জাতির কাঁধে যখন এত লাশের বোঝা তখন চোখ ধাঁধানো বিজয় দিবসের এত আনন্দ জাতির কী কাজে লাগবে, এই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীকে। বিজয় দিবস করার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। তিনি যদি একাই সব করেন, রাজউকের দায়িত্ব নেবেন কি? বিজয় যেন আওয়ামী লীগের একার সম্পদ। জাতীয় শোক দিবসেও কাঁদতে দেয়া হলো না। অথচ জাতি এক মাস ধরে শোক উদ্যাপন করে।
এত দ্রুত বিলিয়নিয়ার হওয়া যায় আর কোন দেশে? গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি দেয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই টাকা রাখার জায়গা খুঁজতে বিদেশে যেতে হয়। মানুষ মারলে জেলজরিমানা কোনোটাই হয় না। ২৭ নভেম্বর মার্কিন মিডিয়ায় দীর্ঘ এক ঘণ্টার টকশোতে এ কথাগুলোই উঠে এসেছে। অবাক লাগে, আমাদের বিষয়ে এরা কত বেশি জানে। সারা পশ্চিমে এই খবর নিয়ে চলছে তোলপাড়।
বাংলাদেশকে এক নম্বর বানাতে মাঠে আছেন ড্যান মজিনা, সরকার ও বিজিএমইএ। সবার উদ্দেশ্য সস্তা কাবাব, ৩৭ ডলারে খাওয়া। সরকার এদের সহায়তা করছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে এবং আমিনুল ইসলামদের গুম করে। ট্রেড ইউনিয়ন এবং কোনো ইউনিয়নই গড়তে দেয়া হয় না, যেন নিম্নমজুরির বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে, বছরের পর বছর দ্রব্যমূল্য বাড়লেও যেন বেতন না বাড়ে। রাষ্ট্রই যখন সন্ত্রাস, তখন সন্ত্রাসী খুঁজে লাভ কী? এরা বড় বড় ডোনার, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বিশ্বরেকর্ড তৈরি করে। কত বড় অবিবেচক হলে গার্মেন্ট মালিকেরা জাতীয় শোক দিবসেও প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পার্টি আয়োজন করে? এদের ইজ্জত বলতে কিছু কি নেই? আমরা জানতে চাই, এদের লাভের অঙ্ক কত? ৩০ পয়সা খরচ করে ৯০ ডলারে বিক্রি, মহা পুঁজিবাদীদের তালিকায় বাংলাদেশ এক নম্বরে।
ড্যান মজিনারা জানেন, ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ নিউ ইয়র্ক শহরে ঠিক এই রকম অগ্নিকাণ্ডেই ১৪৬ জন গার্মেন্ট কর্মী যখন লাশ হলো তখনো তাজরীন ফ্যাক্টরির মতো বাইরের গেটে তালা। ধোঁয়ায় অন্ধকারে মানুষেরা জানালা ভেঙে ৬-৭ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। এর পরই তৈরি হয় শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইন। তার পরেও প্রতি বছর দুর্ঘটনায় টনক নড়েনি। তাজরীনের ঘটনা শত শত মৃত্যুর সফলভাবে ধামাচাপা দিয়েছে বিজিএমইএ। এখন পর্যন্ত নিজেদের উদ্যোগে কোনো তালিকা প্রকাশ করেনি। ভাইস প্রেসিডেন্ট ঘটনাস্থলে সাফাই গাইলেন, গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়, সে তুলনায় গার্মেন্টে মানুষ মরে কম। এ ধরনের বক্তব্য পশ্চিমের মিডিয়ার কানে পৌঁছাবে কে? এমন ঘটনা বারবার ঘটে কারণ শ্রমিক মরলে কিছুই হয় না। তাৎণিকভাবে সরকার আর মহাজনদের ল টাকা তিপূরণের মুখস্থ ঘোষণা পর্যন্ত শেষ। জীবন শুধু মহাজনদেরই। ভবনের ভেতরে-বাইরে যেমন বহির্গমনের সিঁড়ি থাকে না, তেমনি ফায়ার ব্রিগেড ঢোকার রাস্তা পর্যন্ত নেই। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ন্যূনতম রাস্তা থাকবে ২৭ ভাগ, সেখানে আছে মাত্র ২ থেকে ৭ ভাগ। ফায়ার ব্রিগেডে পানি থাকে না, প্রধানমন্ত্রী পুকুর কাটার দায়িত্ব দিলেন বিজিএমইএকে? এ কী উদ্ভট সরকার! উদ্ভট প্রশাসন!
পুরো ঘটনা দেখতে চাই আন্তর্জাতিক প্রোপটে। এই হত্যাযজ্ঞের জন্য প্রথম দায়ী বিদেশী ক্রেতা, যারা বিল্ডিং কোড ও ফায়ার সেফটি জানা সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানিকে অর্ডার দেয়। ছোটখাটো আবাসন ব্যবসায়ী হওয়ায় বিল্ডিং কোড আমার নিজের মুখস্থ। অগ্নিনিরাপত্তা বিল্ডিং কোডের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি, যে ভবনে বহির্গমনের সিঁড়ি নিয়ে সমস্যা, সেই ভবন কোনো দিনই আলোর মুখ দেখবে না। অভিযোগ করলে ফায়ার ইউনিট হাজির হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। সিঁড়ির সংখ্যা এবং প্রস্থ হয় মানুষের সংখ্যার ভিত্তিতে অর্থাৎ এক হাজার ৮০০ স্কয়ার ফুটের বেশি হলেই বহির্গমনের জন্য দুই সিঁড়ি। এরপর লাইভ লোড বুঝে সিঁড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে তুলনায় তাজরীনের েেত্র অন্তত ১০টি বহির্গমনের সিঁড়ি এবং ভবনের বাইরে দিয়ে বের হওয়ার অতিরিক্ত সিঁড়ি ছাড়া এই ভবনটি পোশাক শিল্পের উপযুক্তই নয়। এ ধরনের শিল্পের জন্য তাৎণিক ঝরনা অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিটি বহির্গমনের সিঁড়ি শেষ হতে হবে সরকারি রান্তার ওপর। আশপাশে থাকবে না একটিও প্রতিবন্ধকতা। অগ্নিবান্ধব কিছুই থাকবে না। ৩০ ফুট দূরে দূরে বৈদ্যুতিক পথনির্দেশনা এবং আলোকিত বহির্গমন সাইন। তাজরীনের েেত্র তিনটি সিঁড়ি শেষ হয়েছে একই জায়গায় এবং তা রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে, আর এই এলাকাতেই বানানো হয়েছে গোডাউন যেখানে অত্যধিক অগ্নিবান্ধব মালপত্র রাখা ছিল। আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ওৎখানেই।
গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির অনিরাপত্তা নিয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় এত প্রচারসত্ত্বেও ঢাকায় এসে কিভাবে তারা চুক্তি সই করেন? গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তো কথার জাদুকর। সরকার, পশ্চিমের রাষ্ট্রদূতেরা ও বিজিএমইএÑ তিন প মিলে তৈরি করেছে সস্তা শ্রমের কারবালা। ঘুষের প্রচলন এবং সমর্থন সব পই জানে। ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে সামান্য শ্রেণীবৈষম্যের অভিযোগে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তিপূরণ দিচ্ছে, সেখানে এরাই আমাদের শ্রমিক হত্যা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদেরই প্রতিটি পরিবারের পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। যথেষ্ট তিপূরণ আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে। আমার বিশ্বাস দেশে পশ্চিমের ভোক্তারা জানলে করপোরেশনগুলোকে বাধ্য করবে বাংলাদেশী পোশাক বর্জন করতে যেভাবে আশির দশকে করেছিল চামড়ার কোট এবং নব্বইয়ের দশকে হীরার ব্যবসায়।
যা হোক, কয়েক দিন পরেই এত মৃত্যুর কথা ভুলে যেতে হবে। কারণ, জায়গা দিতে হবে নতুন সঙ্কটের। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটাই কাজÑ শ্রমবাজার খোঁজা, এ ছাড়া বাজেট হয় না। বাংলাদেশের মানুষ কি শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য জন্ম নিয়েছে? বিদেশীরা আউটসোর্সিং করে গার্মেন্টে বিনিয়োগ করে ২০ বিলিয়ন, শ্রমবাজার থেকে আসে আরো ২০ বিলিয়ন। কারণ আমাদের দেশে কর্মত্রে বলতে কিছু নেই। ৩০ বিলিয়ন ডলার না হলে, আবারো ’৭৪ হবে, বাসন্তীরা জাল পরবে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের ছাগলটি আজ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না। আগুন লাগার পর দায়ী ব্যক্তিদের মূল সংগঠন বিজিএমইএ’র প থেকে আত্মীয়স্বজনের জন্য সার্বণিক ক্রাইসিস সেন্টার খোলা হয়নি কেন? শ্রমিকদের পরিচয়, হাজিরা খাতা, অনুসন্ধান কোনো তথ্যই বিজিএমইএ দিচ্ছে না। পত্রিকায় প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না বরং টকশোতে গিয়ে গলাবাজিতে লিপ্ত। এত বড় দুর্যোগ ঘটল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শহরে থেকেও দেখতে গেলেন না। অথচ হাসপাতালে আগুন লাগলে ‘পাষাণ’ বলে কথিত মমতা ব্যানার্জিকে পর্যন্ত ছুটে যেতে দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান যেখানে গেলে মতা রা হবে। সেই অর্থে তাজরীনের কিছু ভোটার লিস্ট থেকে বাদ। কারখানার মালিকদের রহস্যময় আচরণ, পর্দার অন্তরালে জজ মিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
বিদেশে এই মাপের প্রতিটি খুনের তিপূরণ ন্যূনতম দুই থেকে তিন মিলিয়ন ডলার। অবহেলাজনিত হত্যার দায়ে জেল। ঘুষ দিলে ন্যূনতম ৫০ হাজার ডলার জরিমানা এবং পাঁচ বছরের জেল। ড্রোনাল ট্রাম্পের হোটেলে মাছের একটি বাতিল কৌটা পাওয়া গেলে পুরো হোটেলই বন্ধ করে দিলো স্বাস্থ্য বিভাগ। ড্যান মজিনার নেতৃত্বে পশ্চিমের ক্রেতারা বাংলাদেশ সরকার ও মাফিয়া চক্র সাথে নিয়ে যে খেলায় মেতেছেন, এর বিরুদ্ধে সচেতন সবাইকে প্রতিবাদ করতে হবে। খোদ নিউ ইয়র্ক শহরেই প্রতিটি দূতাবাসের সামনে বিােভ করার নিয়ম আছে, এমনকি বাংলাদেশ মিশনের সামনেও ঘেরাও হয়। আমাদের দেশেও দূতাবাস ঘেরাও কালচার শুরু করতে হবে এবং তাজরীনের ঘটনা দিয়েই তা শুরু হোক। দুর্ঘটনারোধে দিনটিকে প্রতি বছর ‘গার্মেন্ট শোক দিবস’ হিসেবে পূর্ণ বেতন দিয়ে কারখানা বন্ধ রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী যখন ভোটের ছিনিমিনির কথা বলেন, আমি তখন প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার নিয়ে মারাত্মক শঙ্কিত। একই দিনে তাজরীন ও বহদ্দারহাটের ঘটনায় নেত্রীদের হৃদয়হীনতায় স্তম্ভিত। এই মুহূর্তে ৯৯ ভাগের আন্দোলন যদি পৃথিবীর কোথাও নিরঙ্কুশ প্রয়োজন হয়, তা শুধু বাংলাদেশেই।
No comments:
Post a Comment