Tuesday, December 4, 2012

করমজলে পরম আনন্দ মাহফুজ রহমান |


করমজলের প্রধান ফটকে পা রাখতেই গম্ভীর প্রকৃতির এক বানরের সঙ্গে দেখা। তার ভাবখানা এমন—আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে! আমরা যে তিনজন জলজ্যান্ত মানুষ সামনে দণ্ডায়মান, তাতে তার মাথাব্যথা নেই মোটেও। প্রধান ফটক থেকে ১০-১২ পা এগোলেই কাঠের টানা সেতু পড়ে একটা। সেখানে মচ্ছবে মেতে ছিল একদল বানর। আমাদের দেখে সেতু ছেড়ে কাদা-মাটি আর গাছে আশ্রয় নিল বিচিত্র ভাষায় চিৎকার-চেঁচামেচি করতে করতে। মনুষ্য-উপস্থিতি যে তাদের বিরক্তির কারণ, তা বেশ স্পষ্ট। তবে পশুর নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা করমজল আমাদের চোখে সুন্দর ধরিয়ে দিল সহসাই! সুন্দর না ধরে উপায় তো নেই, সুন্দরবন বলে কথা! মধ্য দুপুর, পশুর নদীতে তখন ভাটা। সুন্দরীগাছের শ্বাসমূল শ্বাস নিচ্ছে আরামসে। আমাদের গাইড ১৩-১৪ বছর বয়সী রাজু বলল, ‘মামা, কিছুক্ষণ পরই দেখবেন এই জায়গাটা পানিতে সয়লাব!’ মানে জোয়ারের সময় নদীর পানি ঢুকে যাবে বনের ভেতরে। এদিকে আমাদের মনে ঢুকে গেছে ভয়! বনের ভেতরে বাতাস উধাও! পাখির কলতান নেই, নেই গাছের পাতার ফিসফিসানি। আছে কেবল প্রকৃতির স্তব্ধ মোহনীয়তা। আর আছে একটা ছোট্ট সাইনবোর্ড—‘সাবধান! এই জায়গায় একা চলাফেরা করবেন না!’ সাইনবোর্ড ছোট হলে কী হবে, বিশাল ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! গাইড রাজুর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে মনে হয়েছে, ছেলেটা আস্ত একটা ‘বনকোষ’! সুন্দরবন তো সুন্দরবন, আফ্রিকার বনাঞ্চল সম্পর্কেও তার স্পষ্ট ধারণা। তাই সে-ই যখন বলল, ‘কয়দিন আগে এই জায়গা থেইকা একজনরে ধইরা নিয়া গেছে!’ তখন অবিশ্বাস করি কোন সাহসে! কিন্তু কে নিয়ে গেছে? তার কথা না-হয় মুখে না বলি! আমরা তাকে ‘মামা’ বলেই ডাকি বরং!
‘মামার’ ভয় থাকলেও সাহস জোগাল সবুজ প্রকৃতি। টানা কাঠের সেতুর শেষ মাথায় ছোট্ট একটা ছাউনি। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে সেখানে রোদের আলো আঘাত হানছিল স্বমহিমায়। ছাউনিতে বসলেই চোখে পড়ে পশুর নদী থেকে বেরিয়ে আসা ছোট্ট একটা শাখা। সেখানে মাছের পোনা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যবিহীন। চকিতেই একটা মাছরাঙা ইস্পাত নীল ডানা মেলে উড়ে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় রুপালি মাছ। কাঁপন লাগে অচিন গাছের ঝিরিঝিরি কচি সবুজ পাতায়। এদিকে গাঢ় লাল রঙের কাঁকড়ারা তখন টুক-পলান্টিস খেলায় ব্যস্ত! কাঠের সেতু ছেড়ে আমরা পা রাখলাম ডানে, মাটির রাস্তায়। দুই পাশে গোলপাতা আর বাঁশঝাড়। পৌঁছে গেলাম ফিরতি পথের আরেকটি কাঠের সেতুতে। সেতুতে পা রাখতে না-রাখতেই গাইড রাজুর হিসহিসানি কণ্ঠস্বর, ‘মামা, পাইছি মামা!’ কী পেল সে? পেয়েছে একটা গাবদা-গোবদা কাঁকড়ার দেখা! ব্যাগটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লুঙ্গিতে মালকাছা দিল সে! জোয়ারের পানিতে নেমে পড়ল কোনো রকম শব্দ না করে। বকের মতো পা ফেলে সে ঠিকই চলে গেল কাঁকড়াটির সামনে! ঝানু শিকারির মতো ঝপ করে হাত ফেলে চিৎকার করে উঠল রাজু, ‘মামা রে মামা, কামড়ে ধরেছে!’ অবশেষে কাঁকড়াটাকে কবজা করে বিজয়ীর হাসি হেসে সেতুতে উঠে এল সে! 
ফিরতি পথের সেতু পেরিয়ে আমরা পড়লাম অগাধ জলে! অগাধ জল বলতে নদী-সমুদ্র ভাবলে ভুল হবে, মামুলি পুকুর একটা। এই পুকুরেই তিনটি ভয়ংকর কুমিরের ঠিকানা! তবে হতাশার নিঃশ্বাস পড়ল কুমির লাপাত্তা দেখে। পরক্ষণই আবার দম আটকে গেল কাঙ্ক্ষিত প্রাণীর বিকট মূর্তিতে! পুকুর পাড়ে একটা কুমির শুয়ে আছে মুখ হাঁ করে। নট নড়ন-চড়ন! সামনেই তারের জাল দিয়ে ঘেরা খোলা প্রান্তর। একপাশে বানরদের জন্য বানানো একটা ঘর, তারই ছায়ায় গা লাগালাগি করে দাঁড়িয়ে আছে একপাল হরিণ! তাদের চোখে ‘আহা রে কী মায়া!’ ওদিকে খালের জলে পড়ল বকের ছায়া! অনেক কাছে যাওয়ার পরও বকটা তপস্বীর মতো স্থির-শান্ত। যেমন শান্ত করমজল। শান্ত এবং সুন্দর!

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে খুলনা। খুলনা থেকে মংলা। মংলা যাওয়ার বাস পাবেন খুলনার যেকোনো বাসস্ট্যান্ডে। মংলায় নামলে নদী পার হওয়ার ট্রলার খুঁজতে হবে না; ট্রলারওয়ালারাই খুঁজে বের করবে আপনাকে! মংলা থেকে করমজল যাওয়ার জন্য ট্রলারই ভালো বাহন। দর-দাম করে ভাড়া ঠিক করে নিন। খুব বেশি হলে গুনে দিতে হবে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের করমজলে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়। টিকিটের দাম ২৩ টাকা। বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের পাশাপাশি একটি জাদুঘরও আছে সেখানে। জাদুঘরে আছে বাঘ, হরিণসহ বেশ কিছু প্রাণীর কঙ্কাল, কুমিরের ডিম ও বিভিন্ন প্রাণীর মমি করা দেহ। তবে সাবধান, একা একা ভেতরে ঢুকবেন না!

No comments:

Post a Comment